মানুষ জন্মগতভাবে সুন্দরের পূজারী। তাই সুন্দরের প্রতি সবার একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে। ঝকঝকে ও পরিচ্ছন্ন হাতের লেখা সবারই নজর কাড়ে। হাতের লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল শিল্প। যা সবার কাছে সমাদৃত ও সুন্দর ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। প্রযুক্তির এই যুগে অনেকের ধারণা হাতের লেখার তেমন একটা গুরুত্ব নেই। অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর এ সমাজে হাতের লেখা শিল্পের চর্চা বিলুপ্তপ্রায়। কারণ, লেখার জন্য এখন কম্পিউটার ও ল্যাপটপ রয়েছে। কিন্তু পরীক্ষা ক্ষেত্রে উত্তরপত্রে এসব ডিভাইস কোনো কাজে আসবে না। সেখানে হাতের লেখাই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা সুন্দর হওয়া বাঞ্ছনীয়।
পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাওয়ার অন্যতম প্রধান প্রভাবক সুন্দর হাতের লেখা। হাতের লেখা সুন্দর হলে ভাল নম্বর পাওয়া যাবে। পরীক্ষার উত্তরপত্রে হাতের লেখা সুন্দর, স্পষ্ট এবং গোছানো উপস্থাপন হলে পরীক্ষকের একটা আলাদা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়; যা ভাল নম্বর পাওয়ার জন্য সহায়ক। পরীক্ষক সহজে পড়তে পারেন। তাছাড়া পরীক্ষার্থীর সুন্দর হাতের লেখা তার মনোযোগ, পরিশ্রম ও যত্নশীলতাও প্রমাণ করে। সর্বোপরি পরীক্ষার্থী সম্পর্কে পরিক্ষকের একটা ইতিবাচক ধারণাও তৈরি করে যার প্রভাব পরে সম্পূর্ণ খাতা মূল্যায়নের উপর। হাতের লেখা সুন্দর হলে পরীক্ষায় অধিক নম্বর পাওয়াও সহজ হয়।
পরীক্ষায় ভাল ফলাফলে সুন্দর হাতের লেখার গুরুত্ব অপরিসীম। হাতের লেখা উপস্থাপনই সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তির চাবিকাঠি। ভালো ফলাফল নির্ভর করে পরীক্ষার্থীর প্রণান্তকর প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের উপর। অনেক শিক্ষার্থী সময়ের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে লিখে যায়। হাতের লেখার প্রতিও গুরুত্ব দেয় না; হাতের লেখা সুন্দর করে লেখার চেষ্টাও করে না। সে জন্যে মেধা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্খিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়; পরীক্ষায় নম্বর কমে যায়। সুতরাং, হাতের লেখা সুন্দর হতে হবে এবং পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন হতে হবে।
হাতে লিখলে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালনকারী কোষগুলো সক্রিয় হয় এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। কোনো কিছু লিখলে সেটা স্মৃতিতে দীর্ঘদিন থাকে। এর মধ্য দিয়ে শিশুদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। সুন্দর হাতের লেখা যেমন মেধা এবং ব্যক্তিত্বের পরিচয় দেয়, তেমনই লেখার মাধ্যমেই কিন্তু হয়ে ওঠা যায় অন্য আর দশ জনের থেকে অনন্য। এক্ষেত্রে অভিভাবকগণ তাঁদের সন্তানদের উৎসাহিত করতে পারেন। ছুটিকালীন সময়ে সকল শিক্ষার্থীর উচিত হবে হাতের লেখা সুন্দর করার চর্চা করা।
ধৈর্য এবং ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমেই হাতের লেখা সুন্দর করা সম্ভব। হাতের লেখা সুন্দর করার অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে প্রতিটি বর্ণ বা অক্ষর সঠিকভাবে সুন্দর করে লেখা। কারণ, হাতের লেখার সৌন্দর্য নির্ভর করে প্রতিটি অক্ষরের সঠিক আকার ও বিন্যাসের ওপর। স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ প্রতিটি অক্ষর আলাদাভাবে হুবহু লিখতে হবে। প্রতিটি বর্ণ সুন্দর করে লিখলে প্রতিটি শব্দ সুন্দর হবে, প্রতিটি লাইন সুন্দর হবে, পুরো লেখাটিই সুন্দর লাগবে। বর্ণের পাশাপাশি লাইন গ্যাপ, মাত্রা ঠিক রাখতে হবে। হাতের লেখা সুন্দর করতে কাটাকাটির অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। যদি কাটতে হয়, সোজা এক টানে কাটতে হবে। কোনো ধরনের ঘষামাজা করা যাবে না। তাতে লেখার সৌন্দর্য কমে যায়।
অনেকেরই লেখা বাঁকা হয়। বাঁকা লাইন লেখার সৌন্দর্যকে নষ্ট করে। লাইন সোজা রাখতে হবে; লেখা সবসময় মাঝারি সাইজের হলে লেখা দেখতেও সুন্দর লাগে। অন্যের লেখায় কোন কোন বর্ণ বা শব্দ দেখতে ও লিখতে যদি ভাল মনে হয়, সেগুলো অনুকরণ করা বা বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট থেকে লেখা সংগ্রহ করে যেটা ভাল দেখায়, সেটা অনুকরণ করা যেতে পারে। তাতে নিজের মনে আনন্দের সঞ্চার হবে। সুন্দর হস্তাক্ষরের জন্যে অন্যের বাহবা পাওয়া যাবে। সব চাইতে বড় কথা, নিজেরও সম্পদ হলো, ভাল নম্বর পাওয়ার একটি উৎসও মিলে গেল।
শিক্ষার্থীদের সিলেবাসে সুন্দর হাতের লেখাকে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাতের লেখার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলে শিক্ষার্থীদের লেখার প্রতি আগ্রহ বাড়বে বৈ কমবে না। ইতোপূর্বে শ্রেণীর পরিক্ষায় হাতের লেখার জন্য নম্বর বরাদ্দের প্রচলন ছিল; যদি আগের সেই নিয়মটি আবারও প্রচলন করা যায়, তাতে শিক্ষার্থীদের হাতের লেখার প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
বিশ্ব হাতের লেখা দিবস ১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়। ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ‘হ্যান্ডরাইটিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’-এর ব্যানারে দিবসটি পালন করা হয়। দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘হাতের লেখা দিবসের অঙ্গীকার লেখা হোক সুন্দর ও পরিষ্কার’।
পেশাগত জীবনেও সুন্দর হাতের লেখার গুরুত্ব ব্যাপক। অনেক ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ফার্মেন্সিতে নিয়ে দিলে ওষুধের নাম সঠিকভাবে পড়ে সরবরাহ করতে পারে না। এটা একজন রোগীর জন্য যেমন দুঃখজনক তেমনি সবার জন্য দুঃখজনক। ইংরেজীতে একটা কথা আছে, ‘Practice maker a man Perfect’. অর্থাৎ, যতো অনুশীলন করবে, ততো দক্ষ হবে। কোনো কিছু অর্জন করার মূলমন্ত্র হলো কঠিণ অধ্যাবসায় ও সাধনা করা। হাতের লেখা সুন্দর করতে অধিক অনুশীলন করার কোনো বিকল্প নেই। বেশী থেকে বেশী হাতের লেখার চেষ্টা অব্যাহত থাকতে হবে।
লেখক : ফিচার রাইটার, নাট্যকার, গবেষক ও লেখক।