ছোটবেলা থেকেই তামা, কাঁসা, পিতলের সঙ্গে পরিচয় ছিল। বাংলাদেশের তামার সংকর ধাতুসমূহকে পাঁচ ধরনের নামকরণ করা হয়। তামা, কাঁসা, পিতল, ব্রোঞ্জ ও ভরণ। তামার সঙ্গে দস্তা গলিয়ে পিতল, তামা আর টিনের সমন্বয়ে ব্রোঞ্জ ও কাঁসা, তামার সঙ্গে দস্তা ও সিসার মিশ্রণে ভরণ তৈরি হয়ে থাকে।
এ দেশে তৈরি তামা-কাঁসা-পিতল ও ব্রোঞ্জের দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্যাদির প্রাচীন ঐতিহ্য ও শিল্পনৈপুণ্য অতীত থেকে অদ্যাবধি বিদ্যমান। বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি ও লোক-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার। একসময় আমাদের দেশে পিতল তামা-কাঁসার তৈজসপত্রের ব্যবহারের খুব প্রচলন ছিল। বিশেষ করে রান্নাঘরের তৈজসপত্রে ও ব্যবহার্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে তামা-কাঁসার থালা, বাটি, গ্লাস, রান্নার হাঁড়ি ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো।
বিভিন্ন নামকরণে তামা, কাঁসা থেকে তৈরি থালা বাটি এবং গ্লাসকে বিভক্ত করা যায়। যেমন, থালা ও গ্লাসের মধ্যে রয়েছে রাঁধাকান্তি, বংগী, বেতমুড়ি, রাজেশ্বরী, রত্নবিলাস, কাস্তেশ্বরী, রাজভোগী, ঘুটা ও কলতুলা। বাটির নামের মধ্যে আছে জলতরঙ্গ, রামভোগী, গোলবাটি, কাজল বাটি, রাজভোগী, ফুলতুলি, ঝিনাই বাটি। তাছাড়াও কৃষ্ণচূড়া, ময়ূরকণ্ঠী, ময়ূর আঁধার, মলিকা ইত্যাদি নামে বিভিন্ন ধরনের জগ পাওয়া যেত। চন্দ্রমুখী, চাপিলামুখী, পঞ্চমুখী, ঝিনাইমুখী নামে চামচও পাওয়া যেত। হয়তো এখনো পাওয়া যায়। অনেক বছর আগে থেকেই মানুষজন পারিবারিক ও ধর্মীয় কাজে এসব জিনিসপত্র ব্যবহার করে আসছে। একটা সময় ছিল তামা-কাঁসার জিনিসপত্র ব্যবহারকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। দক্ষ কারিগররা বিভিন্ন তৈজসপত্রের ওপর কারুকার্য ও নকশায় লোকজ মোটিফ তুলে ধরেন, যেমন—ফুল, পাখি, লতাপাতাসহ নানান চিত্র।
এই শিল্প এখনো পড়ে আছে দেশের এক নিভৃত কোণে। ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারছে না তামা, কাঁসা, পিতলের শিল্প। যুগের পর যুগ এ পেশা আঁকড়ে ধরে টিকে থাকা কারিগরদের আক্ষেপ—চকচকে স্টিল, প্লাস্টিক আর মেলামাইনের দাপটে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী কাঁসা ও পিতলের শিল্প। পৈতৃক পেশাকে ধরে রাখার জন্য বর্তমানে ঢাকার শাঁখারীবাজার, ইসলামপুর, মিটফোর্ড রোডের কয়েকটি পরিবার এবং টাঙ্গাইলের কাগমারী, জামালপুরের ইসলাপুর, বগুড়ার শিববাড়ী, মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের কিছু মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত আছে।
একসময় ইসলামপুরের কাঁসাশিল্প বিশ্ববাজারে বেশ কদর ছিল। আজ থেকে দুই যুগ আগেও কোনো বিয়েশাদি, আকিকা, সুন্নতে খতনাসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে দেওয়া হতো কাঁসার জিনিসপত্র। ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ সালে লন্ডনের বার্মিংহাম শহরে সারা বিশ্বের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। ঐ প্রদর্শনীতে ইসলামপুরের কাঁসাশিল্পের কারিগর স্বর্গীয় জগত্ চন্দ্র কর্মকার ইসলামপুরের কাঁসার তৈজসপত্রাদি প্রদর্শন করেছিল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্প হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করে। এরপর থেকে সারা বিশ্বে ইসলামপুরের কাঁসাশিল্পের পরিচিতি ঘটে।
কাঁসা ব্যবহারে নেই কোনো ধরনের ঝুঁকি। তাই খাবার ও পানি রাখার জন্য সবচেয়ে উত্কৃষ্ট ধাতু বলা হয় কাঁসাকে। জানা যায়, কাঁসার পাত্রে রাখা খাবার খেলে পাকস্থলীতে থাকা বেশ কিছু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়। প্রতিদিন কাঁসার গ্লাসে পানি পান করলে শরীরের দূষিত পদার্থ বেরিয়ে যায়। লিভার ও কিডনির কর্মক্ষমতা বাড়াতেও কাজে আসে ধাতুটি। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি বলছে, কাঁসার পাত্রে খাবার খেলে হার্ট অ্যাটাক, কোলেস্টরল এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের ঝুঁকি কমে। শরীরে তামার ঘাটতি দূর করতে সাহায্য করে কাঁসা। ফলে মস্তিষ্কে থাকা নিউরনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও স্মৃতিশক্তি বাড়ে।
তামা-কাঁসার তৈজসপত্রের চাহিদা থাকলেও দক্ষ জনবল এবং কাঁচামালের অভাবে উত্পাদন বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র তৈরি করার জন্য শ্রমিকদের সকাল থেকেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়। হাতুড়িপেটা থেকে শুরু করে অনেক শারীরিক কসরত যায় এ কাজে। ফলে তারা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কয়েক জন শ্রমিক মিলে তিন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচটি থালা বানাতে পারবেন। যদি মেশিনের সাহায্য নেওয়া যায়, তাহলে কমপক্ষে ১০-১৫টি থালা বানানো সম্ভব। শিল্পটিকে যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। আর তা হলেই উত্পাদন বাড়বে। বাজারেও সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার খুব বেশি প্রয়োজন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে অস্তিত্ব বিলীন হবে এই শিল্পের।
এই শিল্প ঐতিহ্য হারাতে বসলেও বর্তমান সৌখিন মানুষের কাছে চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নানা রকম শো-পিস, ওয়াল ম্যাট, ফুলের টব, বিভিন্ন ধরনের গ্লাস, থালা, বাটি, কাজলদানি, চামচ, হুক্কা, কলস, ঘণ্টা, গামলা, চামচ, বালতি, ডেগ, কড়াই, প্রদীপ, সংগীত সাধনার যন্ত্র, খেলনা, আয়নার ফ্রেমের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শিল্পের উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনী উদ্যোগ হিসেবে কাজ করবে। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পর্যটন মন্ত্রণালয় ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহকে যুক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা গেলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। অনেক ব্যবসায়ী গণমাধ্যমে বলেন কাঁচামালের দাম কম হলে এই পেশার প্রতি মানুষ আবারও ঝুঁকবে।