আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিসরে সর্বাধিক জনপ্রিয় পরিবহনের নাম রেল। বর্তমান সময়ে দেশের অভ্যন্তরে রেল যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। বিশেষ করে পর্যটকরা নিরাপদ বাহন বলে মনে করেন। রেল প্রতিদিন আড়াই লাখের অধিক এবং বছরে সাড়ে ৮ কোটি যাত্রী বহন করে। পানিপথ সংকোচিত, সড়কপথে দুর্ঘটনার কারণে রেলে যাত্রীর ভিড় থাকে। তার পরও রেলের আয় বাড়ছে না! বহুমুখী সমস্যায় যাত্রীসেবার মানও সন্তোষজনক নয়।

গত ২৭ জানুয়ারি রেল-কর্মচারীদের হঠাত্ ধর্মঘটে পুরো দেশ অচল হয়ে যায়। ৬২ ঘণ্টার এ ধর্মঘটে কমলাপুর স্টেশনসহ দেশের ৪৯৩টি স্টেশনে হাজার হাজার যাত্রী আটকা পড়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হয়। রোগী, বয়স্ক লোক, প্রতিবন্ধী, শিশু ও গর্ভবতী মহিলা যাত্রীদের কষ্টছিল চরমে। রেলের রানিং স্টাফ, পরিচালক (গার্ড), ট্রেন চালক, সহকারী ট্রেন চালক ও টিকিট পরিদর্শক ১ হাজার ৯০০ জন কর্মচারীর দাবি নিয়ে ডাকা ধর্মঘটকে নজিরবিহীন বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। রেল উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল করিম যাত্রী জিম্মি করে কর্মবিরতি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন। ব্রিটিশ আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ ধরনের ধর্মঘট প্রথম। তাদের দাবি দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে মূল বেতনের সঙ্গে এক দিনের সমপরিমাণ টাকা প্রদান করা। রেলের ভাষায় এটাকে মাইলেজ বলা হয়। এ হিসাবে এক মাস কাজ করলে আড়াই বা তিন মাসের বেতন এবং মূল বেতনের সঙ্গে ৭৫ শতাংশ সংযুক্ত করে পেনশন দিতে হবে। একসময় এ দেশে সড়কপথের অবস্থা খুবই নাজুক ছিল। পানি ও রেলপথ ছিল যাতায়াতের একমাত্র ভরসা। ষাটের দশকে রেল প্রায় ৫০ শতাংশ যাত্রী বহন করলেও ৮০ দশকে ১২ শতাংশে নেমে আসে। ৯০ দশকে পানিপথে যাত্রী বহন কমে গেলে ট্রেনের ওপর চাপ বৃদ্ধি পায়। তখন ট্রেনে গাদাগাদি করে যাত্রীরা যাতায়াত করত এবং বিনা টিকিটে যাত্রীর সংখ্যাও ছিল বেশি। ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটসহ দূরবর্তী মেইল ট্রেনগুলো এক দিনের ট্রেন দুই দিনে আসা-যাওয়া করত। একবিংশ শতাব্দীতে এসে রেলের পূর্ণজাগরণ ঘটে। বর্তমানে দেশের ৪৭টি জেলায় ২ হাজার ৯৫৬ কিলোমিটার রেলপথ থাকলেও ১৭টি জেলায় এখনো রেল-পথ চালু হয়নি। রাষ্ট্র পরিচালনাধীন সম্ভাবনাময় রেল গত ৫০ বছরে আশানুরূপ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। লোকসানের বদনাম যেন রেলের পিছু ছাড়ছে না।
১৯৮৫ সালে আন্তঃনগর ট্রেন চালু হওয়ার পর ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১০৪টি আন্তঃনগর (আপ ও ডাউন), ৫২টি এক্সপ্রেস, ৬৪টি কম্পিউটার ডেমো, ১৩৫টি লোকাল (শাটল) ট্রেন বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে। আন্তঃনগর ট্রেনে হাজার হাজার যাত্রী দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি ট্রেনের টিকিট দেওয়া শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যে সব টিকিট উধাও হয়ে যায়। টিকিট কাউন্টারে অপারেটররা বলে থাকেন, অনলাইন শতভাগ করায় চোখের পলকেই সব টিকিট শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা দিলে টিকিট কাউন্টার বা সিন্ডিকেটের কাছে থেকে টিকিট পাওয়া যায়। রেলের একটি টেকনিক্যাল সিন্ডিকেট টিকিটের জমজমাট ব্যবসা করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে কালোবাজারেও টিকিট বিক্রি করা হয়। গত ২৯ অক্টোবর কমলাপুর স্টেশন ভবনে এক বৈঠকের পর উপদেষ্টা ফাওজুল করিম সংবাদ সম্মেলনে টিকিট কালোবাজারে বিক্রি ও রেলের দুর্নীতির কথা স্বীকার করে পরিবর্তনের আশ্বাস দেন। র্যাব একবার কমলাপুর স্টেশনে হানা দেওয়ায় কিছুদিন যাত্রীরা চাহিদামতো টিকিট পেয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন খান রনি গত বছর রেলের অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ১৯ দিন অনশন করে দেশ জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলেন।
গত ১৫ বছরে রেলের অবকাঠামো খ্যাতে ব্যয় হয়েছে ৮৮ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে ৮৯টি প্রকল্পে ব্যয় হয় ২১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা এবং চলমান ৩২টি প্রকল্পের চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত খরচ ৬৬ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। গত দশ বছরে রেলের উন্নয়নে ২০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলে রেলের কোচ (বগি) যাত্রীনুযায়ী বাড়েনি। প্রতিদিন শত শত যাত্রী টিকিট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। ট্রেনের কোচের জরাজীর্ণ, সিটভাঙা, কাপড় নেই, টয়লেট, ওয়েটিংরুমে মশা-মাছির ভনভন শব্দে যাত্রীরা অতিষ্ঠ। রেললাইনের স্লিপার, পাথর, নাটবল্টু, তেল-ডিজেল চুরি নিত্যদিনের ঘটনা। রেলের দামি যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে বেশি দামে কিনে আনা হলে সংরক্ষণ রুম থেকে যন্ত্রাংশ চুরির ঘটনা ঘটে। রেলের সবচেয়ে বড় সমস্যা, ট্রেন চালকের ২ হাজার ২৩৬টি পদের মধ্যে ১ হাজার ১৩৫ জন কর্মরত, বাকি ১ হাজার ১০১টি পদ শূন্য। ২৯৫টি ইঞ্জিনের মধ্যে অধিকাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ অনেক সময় ট্রেনের টিকিট চেক হয় না, বিনা টিকিটে যাত্রীদের রশিদও কাটা হয় না। রাতের ট্রেনে মাইকে যাত্রী নামার ঘোষণা না দেওয়ায়, যাত্রীরা এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে গিয়ে বিপদে পড়ে। সিলেটগামী ট্রেন শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছলে গতি কমে যায়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পনগরী ছাতক-সিলেট লাইনটির মেরামতের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। স্পিকার মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সিলেট অত্যাধুনিক রেল স্টেশনটি নির্মাণ করলে অতিঅল্প সময়ে ওপরের টিন নষ্ট হয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে। পুরো স্টেশনটি যেন পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। সারা দেশে রেলের ৬১ হাজার ৮৩০ একর ভূমির অধিকাংশ বেদখল। রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, কে কোথায় কাজ করেন, তার কোনো সন্ধান মেলে না।
১৮২৫ সালের জজ স্টিফেন ও পুত্র রবাট স্টিফেন ইংল্যান্ডের ২৬ কিলোমিটার ধাতব ট্রেন চালু করে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তিনি ১৮৪৪ সালে কলকাতা-হাওড়া-রানিগঞ্জ পর্যন্ত রেল নির্মাণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করেন। ১৮৫৩ সালে লড ডালহোসি উপমহাদেশে প্রথম রেলপথ চালুর পর জেপি কেনেডি গঙ্গা নদীর পূর্বদিকে সুন্দরবন হয়ে ঢাকায় রেলপথ স্থাপনের প্রস্তাব করলে, ১৮৫৪ সালে রেঙ্গুন কলকাতা রেলপথ চালু হয়। ১৮৬২ সালে দর্শনা-কুষ্টিয়া প্রথম এ দেশে রেলপথ চালু হয় এবং কুষ্টিয়ার ‘জগতি’ রেল স্টেশন প্রথম স্টেশন। ১৮৮২-৮৪ অর্থ বছরে দর্শনা জংশন-খুলনা ২০৪ কিলোমিটার সেকশন, ১৯১৬ সালে হার্ডডিজব্রিজসহ বেড়ামারা স্টেশনটি চালু করা হয়েছিল। ১৯১৪ সালে পদ্মা নদীর ওপর ১.৮ কিলোমিটার হার্ডডিজব্রিজ, যমুনা নদীর উপর ৪.৮কিলোমিটার দীর্ঘ যমুনা নদীর ওপর ডুয়েল গেজ সেতু নির্মাণ করা হয়।
২০২০-২০২১ সালের আয় ১ হাজার ১৩ কোটি, ব্যয় ৬ হাজার ২৫ কোটি, ২০২২-২৩ সালে আয় ১ হাজার ৭৮৩ কোটি, ব্যয় ৩ হাজার ৩০৭ কোটি! কেন, এর কোনো সঠিক জবাব নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেল লোকসানের প্রধান কারণ—অনিয়ম, দুনীতি, লুটপাট, যাত্রীর চেয়ে বগি ও ইঞ্জিন কম, দক্ষ সত্ লোকের অভাব ইত্যাদি। ১৬২ বছর আগে রেল প্রতিষ্ঠিত হলেও দীর্ঘ সময়ে রেলকে নিয়মের মধ্যে আনার তেমন কোনো প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। সরকার ও রেল প্রশাসন ইচ্ছা করলেই দেশের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় রেলকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে পারত।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, আধুনিক উন্নয়ন চিন্তায় দীর্ঘস্থায়ী ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেল পৃথিবী জুড়ে সম্ভাবনাময় শক্তিশালী এক পরিবহন। রেল নেটওয়াক সর্বোচ্চ যাত্রী বহন করে। রেল এবং রেলের বহুমুখী সমস্যা দূর করা হলে যোগাযোগে গতি অনেক বৃদ্ধি পাবে।
লেখক : কলামিস্ট