অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৪ বছরে পা দিয়েছে। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা জাতির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার মাইলফলক। তবে এই গৌরবময় বিজয় সত্ত্বেও প্রকৃত গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার যে স্বপ্ন জাতি দেখে আসছে, তা এখনো পূর্ণতা পায়নি। স্বাধীনতা-পরবর্তী পাঁচ দশকে একদিকে যেমন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো, তেমনি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক বৈষম্য ও দুর্নীতির কারণে অনেক সম্ভাবনাও রয়ে গেছে অপূর্ণ।
২০২৪ সালের আগস্টে সৃষ্ট নতুন সম্ভাবনার আলোকরশ্মি জনগণের মনে এক নতুন আশার সঞ্চার করেছে বটে। এই সম্ভাবনা একটি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে, যা সঠিক পরিকল্পনা, নেতৃত্বের সততা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ নেওয়ার সুযোগ পাবে। তবে, এই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী এবং কার্যকর হতে হলে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক অগ্রগতির একটি স্থিতিশীল ধারা তৈরি করেছে। রপ্তানি খাতের বৈচিত্র্য, এসএমই খাতের উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়া দেশের সক্ষমতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এ ধারাকে আরো জোরদার করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও দক্ষ নেতৃত্বের প্রয়োজন। ২০২৫ সালে এসব বিষয় গুরুত্ব পাবে বলে প্রত্যাশিত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, যেখানে জনগণ প্রকৃত অর্থে দেশের মালিকানার অনুভূতি পাবে। সবার জন্য সমান সুযোগ, সুশাসন ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন নিশ্চিত করা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। ২০২৫ সালটি যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে সক্ষম হবে এবং একটি সফল, সমৃদ্ধশালী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
গণতন্ত্র ও সুশাসনের মূল উপাদান হলো নির্বাচনি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা। এগুলো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অপরিহার্য অংশ। প্রশাসন যদি দলীয় বা পক্ষপাতিত্বমূলক হয়ে যায়, তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। নিরপেক্ষ প্রশাসনই কেবল জনগণের চাহিদা মেটাতে পারে এবং রাষ্ট্রের প্রতি আস্থার ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।
গণতন্ত্র ও সুশাসনের মজবুত ভিত্তি তৈরির মাধ্যমে একটি দেশ তার আর্থসামাজিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামগ্রিক উন্নতিতে এগিয়ে যেতে পারে। তাই গণতন্ত্র ও সুশাসনের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাই আমাদের জন্য একান্ত প্রয়োজন। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও কর্মসংস্থান একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবুও বৈষম্য ও বেকারত্ব এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ২০২৫ সাল নাগাদ দেশকে শিল্প, কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সমন্বিত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে।
কৃষি খাতও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অপরিহার্য। উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি, সেচব্যবস্থা এবং আধুনিক কৃষিপদ্ধতির ব্যবহার নিশ্চিত করে কৃষি উত্পাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠা করে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে একটি মজবুত সংযোগ স্থাপন করা যাবে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাত দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়া, রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করা অর্থনীতিকে বৈশ্বিক বাজারে আরো প্রতিযোগিতামূলক করতে পারে।
টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্প, কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তির মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু রেমিট্যান্স এবং পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল না থেকে অন্যান্য পণ্য ও সেবা রপ্তানিতে মনোযোগ দিতে হবে। বিদেশনির্ভরতার বদলে আয়ের বিকল্প পথ অনুসন্ধান করতে হবে। এভাবে সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যেতে পারে একটি উন্নত ভবিষ্যতের পথে।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি একটি দেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি। ২০২৫ সালের উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা ও প্রযুক্তিকে একত্র করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার অপরিহার্য। এই শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তি, অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত পরিবর্তন আনছে, যা দক্ষ ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া সামাল দেওয়া কঠিন। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি ও প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।
শিক্ষার গুণমানোন্নয়ন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা উন্নয়নের চালিকাশক্তি হতে পারে। গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলে শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার ঘটানো যেতে পারে। পাশাপাশি, নারী শিক্ষা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণার গুরুত্বও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার সুযোগ বাড়িয়ে নতুন উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব।
নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতা একটি উন্নত সমাজ গঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া কোনো সমাজের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ২০২৫ সালের মধ্যে নারীদের জন্য এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন, যেখানে তারা নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে এবং সমান সুযোগ পায়।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জবাবদিহিমূলক সরকারব্যবস্থা নিশ্চিত করা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক প্রশাসনব্যবস্থা চালু করা হলে জাতীয় ঐক্য আরো শক্তিশালী হবে। জনসচেতনতা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। জনগণের সচেতনতা ছাড়া উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সেই উন্নয়ন স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না।
জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ শুধু সামাজিক উন্নয়নে নয়, বরং পরিবেশ রক্ষা, দুর্নীতি দমন, এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকার ও নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে ২০২৫ সালে উন্নয়নের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। আর এভাবে একটি শক্তিশালী, সুশাসিত ও সমৃদ্ধ দেশ গঠন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৫ একটি সম্ভাবনাময় বছর। এটি একটি নতুন অধ্যায় রচনার সুযোগ নিয়ে এসেছে, যেখানে সম্ভাবনাগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে দেশকে কেবল দক্ষিণ এশিয়ার নয়, পুরো বিশ্বের একটি মডেল রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব। এই সময়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর একটি সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সম্ভাবনাগুলো বাস্তবে রূপান্তর করতে হলে সরকারের জনবান্ধব নীতি, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং জাতীয় ঐক্য ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়