বাংলাদেশের প্রাচীনতম পল্লি অঞ্চলের সর্বনিম্ন প্রশাসনিক একক হলো ইউনিয়ন পরিষদ। গ্রাম চৌকিদারি আইন, ১৮৭০-এর অধীনে ইউনিয়ন পরিষদের সৃষ্টি হয়। এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। এ দেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নাগরিক সেবা পেয়ে থাকেন।
এ দেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে পরিষদের সঙ্গে জড়িত। আবহমানকাল থেকেই এই প্রতিষ্ঠানটি বৈষম্যের শিকার। ব্রিটিশ গেছে, পাকিস্তান গেছে, আওয়ামী লীগ গেছে, বিএনপি গেছে, পল্লিবন্ধুখ্যাত জাতীয় পার্টিও গেছে কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ যা আছে, তা-ই থেকে গেছে। বরং একটা রুগ্ণ ঘোড়ার ওপর বছরের পর বছর ভারী বোঝা চাপানো হয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন সরকার অনুমোদিত ১২ কক্ষবিশিষ্ট দোতলা ভবন। যেখানে চেয়ারম্যানের জন্য একটি কক্ষ (যা স্বয়ংসম্পূর্ণ), সদস্যবৃন্দের জন্য একটি, ইউপি সচিব একটি, সভাকক্ষ একটি এবং ইউনিয়ন পরিষদে ন্যস্ত সাতটি মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তরের ইউনিয়ন কার্যালয়ের জন্য সাতটি কক্ষ বরাদ্দের প্রজ্ঞাপন জারি করা আছে।
চেয়ারম্যানের কক্ষ ছাড়া আর কোনো কক্ষে বাথরুম নেই। একজন মহিলা ইউপি সচিবের জন্য কোনো বাথরুম নেই। সভাকক্ষের ডিজাইন এমনভাবে করা যে, এখানে কোনো ব্যানার টাঙিয়ে মিটিং করার সুযোগ নেই। এই ভবন ডিজাইনে নেই কোনো খাবার ঘর। অথচ ইউনিয়ন পরিষদে ভিজিএফ, ভিডব্লিউবি, জিআর প্রভৃতির বরাদ্দকৃত চাল/গম সাময়িক গুদামজাত করতে হয়। এক সভাকক্ষেই বিভিন্ন সভার আয়োজন, গ্রাম আদালতের এজলাস, খাদ্যগুদাম ইত্যাদি।
উপজেলা পরিষদে ১৭টি মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তরে কার্যালয় ন্যস্ত করা আছে। মোটামুটি সব কার্যালয় সচল ও সক্রিয় দেখা যায়। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই ইউনিয়ন পরিষদে ন্যস্তকৃত সাতটি মন্ত্রণালয়ের ইউনিয়ন কার্যালয় নেই।
ইউনিয়ন পরিষদের সৃষ্টিলগ্ন থেকে ১৫০ বছর যাবৎ একমাত্র কর্মচারী ছিল ইউনিয়ন পরিষদ সচিব। উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ডিডিএলজি, জেলা প্রশাসকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিম্নমুখী সব আদেশ ও নির্দেশ পালনে তিনি হচ্ছেন সব কাজের কাজি। তবে, ২০১৭ সাল থেকে ইউনিয়ন পরিষদে ‘হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর’ পদে নিয়োগ করা হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে কাজের পরিধি বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে অথচ কর্মকর্তা/কর্মচারী সে তুলনায় বেশ অপ্রতুল।
সচিব (বর্তমানে ইউপি প্রশাসনিক কর্মকর্তা) ও হিসাব সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের নিয়োগদাতা জেলা প্রশাসক মহোদয়, মনিটরিং করেন সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার ডিডিএলজি, সার্বিক নিয়ন্ত্রক সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ অথচ তারা সরকারি কর্মচারী নন! কী আজব বৈষম্য। তাদেরকে তো ইউনিয়ন পরিষদ নিয়োগ দেয়নি। সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তা/কর্মচারীর মতো, সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ (সংশোধিত, ২০২৩)-এর ১৫ ধারা ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জন্যও প্রযোজ্য। তাহলে, তারা কেন সরকারি কর্মচারী হবেন না। কেনই-বা সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। স্থানীয় সরকার আইন, ২০০৯-এর ধারা ৮ মোতাবেক ইউনিয়ন পরিষদ প্রশাসনিক একাংশ। ইউনিয়ন পরিষদ প্রশাসনের প্রশাসনিক একাংশ হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর। অথচ ইউনিয়ন পরিষদে নেই কোনো অর্গানোগ্রাম।
একসময় প্রতি ইউনিয়নে তিন জন ব্লক সুপারভাইজার ইউনিয়ন পরিষদ সচিবে অধীনে ন্যস্ত ছিল। আজকে তাদের পদবি উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা। তাদের বেতন গ্রেড ১০ম। অথচ সচিব (ইউনিয়ন পরিষদ প্রশাসনিক কর্মকর্তা)-এর বেতন গ্রেড ১৪তম।
ইউনিয়ন পরিষদে সংযুক্ত পুলিশের বিট অফিসার (স্নাতক) ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা। ইউনিয়ন পরিষদে হস্তান্তরিত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা (কৃষি ডিপ্লোমা) ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা, এলজিইডি-এর উপসহকারী প্রকৌশলী (ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং) ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা। ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার (স্নাতক) ১১তম গ্রেড। ইউনিয়ন পর্যায়ের সব কর্মকর্তার বেতন গ্রেডের উন্নতি হলেও ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের ক্ষেত্রে তা হয়নি। অথচ সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে সম্পর্কিত চেক স্বাক্ষরের ক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিয়ন পরিষদ প্রশাসনিক কর্মকর্তা (স্নাতক/স্নাতকোত্তর) ১৪তম গ্রেডের কর্মচারী!
স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এর চতুর্থ তপশিলে ইউনিয়ন পরিষদের আয়ের খাতসমূহ সম্পর্কে বলা আছে। ইউনিয়ন পরিষদ ১৩টি খাত থেকে আয় হওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ খাত সক্রিয় নয়, অর্থাত্ বর্ণিত সব খাত থেকে আয় করা সম্ভব হয় না। স্থানীয়ভাবে সম্পদ আহরণের নিমিত্ত আদর্শ কর তপশিল, ২০১৩ ইউনিয়ন পরিষদকে প্রদান করা হয়েছে। উক্ত তপশিল যুগোপযোগী নয়। ফলে, ইউনিয়ন পরিষদ নিজস্ব আয়ে পিছিয়ে পড়ছে। যতটুকু আয় করা সম্ভব হয়, তা দিয়ে বিদ্যুৎ বিল, আপ্যায়ন ও মনিহারি পণ্য ক্রয়ের মতোও নয়।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দের ইউপি অংশের ভাতা প্রদান করতে ৬ লাখ ৯৯ হাজার ৬০০ টাকার প্রয়োজন, যা অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদ নিজস্ব আয় দ্বারা মেটাতে ব্যর্থ হয়। ফলে, নিজস্ব আয়ে কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করা সম্ভব হয় না। জাতীয় সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় ইউনিয়ন পর্যায়ে উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। উপজেলা পরিষদ, বরাদ্দের অস্বচ্ছতা বন্ধ করা প্রয়োজন।
লেখক : সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সচিব