নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস সময়টা শীতকাল। শীতকাল মানেই হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় কাঁচা খেজুরের রস খেতে পছন্দ করেন না, এমন মানষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকে আবার টাটকা রস দিয়ে পিঠা-পুলি, পায়েস, গুড় তৈরি করে খায় মনের আনন্দে! কেউ কেউ আবার সারা বছরের জন্য খেজুরের রস সংগ্রহ করে রাখে। তবে শীতকালে কেবল খেজুরের রসেই পাওয়া যায় এক আলাদা রকমের স্বাদ। শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে খেজুরের রসের পরিমাণ এবং মানও কমতে থাকে।
খেজুরের রসে থাকে খনিজ ও পুষ্টিগুণ। বাংলাদেশে যে খেজুর হয়, তাতে যথাযথ পরিমাণ শাঁস থাকে না বলে অনেকেই এটা খেতে খুব একটা পছন্দ করেন না। তাই খেজুরের রসই আসল আকর্ষণ। খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড়ও বেশ লোভনীয়। খেজুরের গুড়ে আয়রণ বেশি থাকে, যা হিমোগ্লোবিন তৈরিতে অনেকটা সহায়তা করে। তাছাড়া শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে খেজুরের রস দারুণ উপকারী।
খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এতে ১৫-২০ শতাংশ দ্রবীভূত শর্করা থাকে, যা থেকে গুড় ও সিরাপ উৎপাদন করা হয়। খেজুরের গুড় আখের গুড়ের চেয়েও বেশি মিষ্টি, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। ঘ্রাণ ও স্বাদের জন্য এ গুড়ের রয়েছে বিশেষ চাহিদা। খেজুরের গুড়ে আখের গুড়ের চেয়ে বেশি প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেল রয়েছে। সকালের নাশতায় খেজুর রসের সিরাপ দিয়ে রুটি খেলে বেশ তৃপ্তি মেলে।
চলুন জেনে নিই খেজুরের রসের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে।
খেজুর রসের উপকারিতা
খেজুরের রসের উপকারিতা যদি জানেন এবার থেকে শীতে নিয়ম করে প্রতিদিন এক গ্লাস খেজুরের রস খাওয়া শুরু করবেন।
রক্ত স্বল্পতা দূর করে
খেজুরের রসে আয়রন সুপ্ত অবস্থায় থাকে। রস ভালোমতো জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হলে তাতে থাকা প্রচুর আয়রন রক্তস্বল্পতা দূর করতে ব্যাপক সহায়তা করে। এজন্য প্রতিদিন অন্তত এক টুকরা গুড় খাওয়া উচিত। বাংলাদেশে খেজুর গুড়ের পিঠা খাওয়া বেশ প্রচলিত রীতি। তাই বিপুল জনগোষ্ঠীর শীতকালে রক্ত স্বল্পতার হাত থেকে রক্ষা পায়।
পেশীকে মজবুত করে
খেজুরের রসে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম থাকে। তাই রস বা গুড় পেশীকে শক্তিশালী করে। পেশীর অসারতা দূর করতেও এটি কাজ করে।
ক্লান্তিভাব দূর করে
খেজুরের রসে রয়েছে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম। এটি পান করলে ক্লান্তিভাব দূর হয় এবং দেহের সজীবতা ফিরে আসে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
রসে প্রচুর এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
হাড় মজবুত করে
খেজুর রসে হাড় ও পেশী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ক্যালসিয়ামের অভাব দূর করে খেজুর রস।
ভিটামিনের অভাব দূর করে
খেজুরের রসে ভিটামিন বি-৩ থাকে। এটি রক্ত উৎপাদন ও ইমিউন সিস্টেমকে সাহায্য করে। ভিটামিন সি কোষের বর্জ্য পদার্থ দূর করে। সর্দি-কাশির হাত থেকে বাঁচায়।
ওজন কমাতে সাহায্য করে
রসের মিষ্টি স্বাদের কারণ অশোধিত চিনি। এটি ধীরে ধীরে রক্তে মিশে যায় ফলে দেহে চর্বি কম জমে। খেজুরের রসে পর্যাপ্ত পটাশিয়াম থাকায় এটি ক্ষমতাকেও বাড়ায়। ফলে অতিরিক্ত চর্বি দেহে কম জমে এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
খেজুর রসের অপকারিতা
খেজুর রসের উপকারিতা জানলেন। এবার অপকারিতাও জেনে রাখুন—
যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের খেজুর রস না খাওয়াই ভালো। কারণ, এর ভেতরে থাকা চিনি ডায়াবেটিসের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। কোনো কিডনি রোগী খেজুর রস পান করলে সমস্যা হতে পারে। রসের পটাশিয়াম কিডনির সমস্যা সৃষ্টি করে। হাপানী বা অ্যাজমা আছে, এমন রোগীর ঠান্ডা রস পান করা উচিত নয়। এতে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যেতে পারে।
কতটুকু রস খাবেন?
একজন সুস্থ মানুষ সকালে এক থেকে দুই গ্লাস রস খেতে পারেন। সকালে খালি পেটে খেলেও সমস্যা নেই। এটি এনার্জি ড্রিংক; তাই শরীরে শক্তি জোগাতে পরিমাণ মতো রস খাওয়া ভালো।
যেভাবে খাবেন
রাতে বা সকালে রস খেতে পারেন বা রসের তৈরি বিভিন্ন খাবার খেতে পারেন। রস যেহেতু খোলা অবস্থায় গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়, তাই এতে জীবাণু থাকতে পারে। এজন্য রস আগুনে হালকা আঁচ দিয়ে বা ফুটিয়ে নিয়ে খাওয়া ভালো। এছাড়া রস জ্বাল দিয়ে বিভিন্ন খাবার তৈরি করে খেতে পারেন।
খাওয়ার আগে কিছু সাবধানতা
খুব সকালবেলা সূর্যের তাপ বেড়ে যাওয়ার আগেই রস পান করা উচিত। সূর্যের তাপ গরম হওয়া রসকে ফারমেন্টেশন করে। ফলে প্রথমে এলকোহল তৈরি হয় এবং পরে আরো ফারমেন্টেশনের কারণে ভিনেগার তৈরি হয়। এ ধরনের রস পান করলে পেট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খেজুরের রস সবসময় ফুটিয়ে খাওয়াই বেশি নিরাপদ।
এখন শীতকাল। এ সময় গাছিরা খেজুরের রস নিয়ে তা থেকে গুড় বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। আবার অনেকে খেজুরের গুড় বানানোর পাশাপাশি খেজুর রস বিক্রিও করেন।
গাছিরা বিকালে খেজুর গাছে মাটির হাঁড়ি লাগিয়ে রাখেন। মাটির হাঁড়ি সর্বদা খোলা অবস্থায় থাকে। রাতে খোলা খেজুর রসের হাঁড়িতে বাদুড় এসে রস পান করে অনেক সময়। ফলে তখন খেজুরের রসের সাথে বাদুড়ের মুখনিঃসৃত লালা মিশে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এভাবে বাদুড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে নিপা নামের এক বিপদজনক ভাইরাস আক্রমণ করে বসে।
নিপা ভাইরাস একটি মারাত্মক ভাইরাস। এই ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে প্রথমে জ্বর আসে, পরে খিঁচুনি হয় এবং এতে মৃত্যুও হতে পারে। যেহেতু রোগটি বাদুড়চাটা খেজুর রস পান করার জন্য হয়ে থাকে, সেহেতু আমাদের খেজুর রস আহরণে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।