সময়ের আবর্তনে ও প্রযুক্তির উত্কর্ষতায় বিশ্ব আজ একক গ্রামে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে একুশ শতাব্দীতে যোগাযোগ, তথ্যের প্রবাহ, সংবাদ প্রচার ও বিনোদনের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বাংলাদেশেও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েই চলেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা।
বর্তমান যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—বিশেষত ফেইসবুক ব্যতীত আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন কল্পনা করাও দুষ্কর। নগর থেকে গ্রামীণ জীবন, কিশোর থেকে তরুণ, মধ্য বয়স্ক থেকে বৃদ্ধ—সবাই আজকের দিনে ফেইসবুক, ইউটিউব, টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত; কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক দিকের সঙ্গে নেতিবাচকতার বিষবাষ্প সমাজে ছড়িয়ে একদল সুবিধাভোগী মানুষ নিজেদের কূটকৌশল বাস্তবায়ন করে থাকে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
গত কয়েক বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠেছে গুজব ছড়ানোর সবচেয়ে ম্যাজিক্যাল প্ল্যাটফরম। বিগত অর্ধযুগ আগেও শুধু তরুণসমাজকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত হতে দেখা গেলেও বর্তমানে টিনেজার থেকে শুরু করে মধ্যবয়স্ক মানুষের মধ্যেও বেড়েছে আসক্তির হার। জানা যায়, দেশের তিন-পঞ্চমাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো নিউজের প্রতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। তবে এই নিউজের মধ্যে ভুয়া বা বিভ্রান্তিকর তথ্যের প্রবণতা অধিক। ফলে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর সংবাদ তরুণদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
একসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার শুধু বিনোদন এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য ব্যবহূত হলেও বর্তমানে এটি সংবাদ প্রবাহের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এছাড়া বর্তমানে ছাপা পত্রিকাগুলোও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের সংবাদ পাঠকদের কাছে পৌঁছায়। তবে এই প্ল্যাটফরমে খবরের সত্যতা যাচাইয়ের তেমন না সুযোগ থাকে না। কেননা, গণমাধ্যমগুলোর সংবাদভিত্তিক কার্ডের নকশা নকল করে অনেকে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য—বিশেষ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য গুজব বা ভুয়া তথ্য ছড়ান, যা অনেক ব্যবহারকারী বিশ্বাস করেন ও শেয়ার করে থাকেন। এর ফলে নেতিবাচকতার আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার জোর আশঙ্কা থাকে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের বড় অংশ অসচেতন। তারা জানেই না, কোন পেইজ বা পত্রিকা থেকে সংবাদ পড়ছেন। অর্থাত্, তারা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর অফিশিয়াল পেজ ফলো না করে বরং সামনে যা আসে, তাই প্রচার করে থাকে। এভাবে তথ্যের সত্যতা যাছাই না করে প্রচার করায় তথ্যবিভ্রাট ঘটে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও গুজবের বিস্তার দেশের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হয়ে উঠছে। ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার ১ হাজার ৩৮০টি ভুল তথ্য শেয়ার শনাক্ত করেছে, যা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৬৯ শতাংশ বেশি। সর্বাধিক ব্যবহূত প্ল্যাটফরম হিসেবে ফেসবুকে ১০১টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে, যা প্রতিদিন গড়ে সাতটিরও বেশি। ইউটিউবে প্রায় ৩৬০টি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফরম টিকটকে ৩৬০টি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। এহেন চিত্র দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে গুজবকে এতটা বিশ্বস্ত করে প্রকাশ করার কাজটি করে দুষ্কৃতকারীরা!
গুজবে কান দেওয়ার ফল অত্যন্ত নেতিবাচক হতে পারে। এর ফলে আতঙ্ক ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, যা দাঙ্গা বা মহামারি পর্যন্ত গড়াতে পারে। সুতরাং, গুজব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। যে কোনো তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে তার সত্যতা যাছাই করতে হবে। ভুয়া তথ্য ছড়ানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অতএব গুজব প্রচারকারীদের আইনের আওতায় আনার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তি, সমাজ ও সরকারের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণই পারে গুজবের ভয়াবহতা রোধ করতে।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়