বাংলাদেশের পোশাকশিল্প একটি নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের ট্যারিফ নীতিগুলো বৈশ্বিক বাণিজ্যের গতিপথ পরিবর্তন করছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগ এই খাত থেকে আসে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে ৯-১০% শেয়ার ধরে রেখেছে। গত দুই দশকে দেশের বাজার অংশীদারিত্ব তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেলেও পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রবণতা এবং নতুন অর্থনৈতিক চাপের কারণে কৌশলগত অভিযোজনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
পোশাক খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি ঐতিহ্যগতভাবে সুতির পোশাকের ওপর নির্ভরশীল, যা খাতটির আয়ের প্রায় ৭০ ভাগ নিশ্চিত করে। তবে বৈশ্বিক ভোক্তাদের চাহিদা বর্তমানে মানবনির্মিত তন্তুর তৈরি পোশাকের দিকে ঝুঁকছে, যা টেকসই, আর্দ্রতা শোষণ এবং ভাঁজ-প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্যের জন্য জনপ্রিয়। মানবনির্মিত তন্তুর তৈরি পোশাকের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ এই ধরনের পোশাকের রপ্তানির পরিমাণ বাড়াচ্ছে। যদিও এই পোশাকের অংশ তার মোট পোশাক রপ্তানির ২৫ ভাগের কম, গত এক দশকে এই খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি ৬ ভাগেও বেশি বেড়েছে। তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ চীন। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চীন সুতির পোশাকের বাজারে তার অংশ কমিয়ে আনছে। তবে, বৈশ্বিক মানবনির্মিত তন্তু থেকে তৈরি পোশাকের বাজারের ৪০ ভাগের বেশি দখল করে চীন এখন বিশ্বের সর্ববৃহত্ মানবনির্মিত তন্তুর তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ সফলভাবে চীনের হারানো সুতির পোশাকের বাজার ধরতে পারলেও বৈশ্বিক মানবনির্মিত তন্তুর পোশাকের বাজারে তার অংশ মাত্র ৬ ভাগ, যেখানে ভিয়েতনামের অংশীদারিত্ব ১০।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো প্রধান পোশাক আমদানিকারকদের মানবনির্মিত তন্তুর পোশাকের আমদানি বৃদ্ধির হার সুতির পোশাকের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সুতির পোশাকের আমদানির হার নেতিবাচক প্রবণতায় রয়েছে। বাংলাদেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের মানবনির্মিত তন্তুর পোশাকের বাজারে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক হিসেবে অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে। তবে, একক বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ এখনো চীন, ভিয়েতনাম এবং ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোভিড মহামারির অর্থনৈতিক প্রভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনসহ বেশ কয়েকটি সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে পোশাক খাত। এর মধ্যে নতুন একটি চ্যালেঞ্জ হলো ‘ট্রাম্প ট্যারিফ ২.০’। এই নীতির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০ ভাগ ট্যারিফ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে, যা চলমান বাণিজ্যযুদ্ধকে আরো তীব্র করেছে। এই ট্যারিফ বাংলাদেশের জন্য দ্বিমুখী প্রভাব ফেলতে পারে। একদিকে, চীনা পণ্যের খরচ বৃদ্ধির কারণে মার্কিন ক্রেতারা বিকল্প সরবরাহের বাজার খুঁজতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা, যারা চীনে বিনিয়োগ করতেন, চীনে ব্যবসা করার খরচ বৃদ্ধির কারণে তাদের বিনিয়োগ অন্য দেশে স্থানান্তর করতে পারেন। এর ফলে বাংলাদেশের জন্য বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ তৈরি হতে পারে। চীনও তার ব্যাবসায়িক খরচ কমাতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে উত্পাদন কারখানা স্থাপন করতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ একটি সম্ভাব্য গন্তব্য হতে পারে। তবে, বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
অন্যদিকে, মানবনির্মিত তন্তুর জন্য বাংলাদেশ চীনের ওপর ৭০ ভাগের বেশি নির্ভরশীল। এই কাঁচামালের উচ্চ ব্যয় বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। পাশাপাশি, অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলোর বিনিয়োগ আকর্ষণের অনুকূল পরিবেশ বাংলাদেশের জন্য বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের পূর্ববর্তী ট্যারিফ নীতির কারণে চীন তাদের বিনিয়োগ অন্য বাজারে সরিয়ে নিয়েছিল, বিশেষ করে ভিয়েতনামে। এতে ভিয়েতনাম বৈশ্বিক বাণিজ্যে শক্তিশালী খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। তবে সে সময়, বাংলাদেশের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে এই সুবিধা কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। এবার চীনের বিনিয়োগ আবারও সরানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এবং বাংলাদেশ মানবনির্মিত তন্তুর খাতে একটি উত্পাদনকেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার আরেকটি সুযোগ পেতে পারে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে মানবনির্মিত তন্তু উত্পাদনে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। এসব কাঁচামালের জন্য একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরবরাহ চেইন প্রতিষ্ঠা করা ব্যয় কমাতে এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি, কৌশলগত নীতি পদক্ষেপ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশ এখনো রপ্তানি ঝুঁড়ি বৈচিত্র্যকরণের ক্ষেত্রে চীন, ভারত ও ভিয়েতনামের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটি ইনডেক্স একটি সূচক, যা একটি দেশের রপ্তানি ঝুঁড়ি কতটা বৈচিত্র্যময় এবং প্রযুক্তিগতভাবে জটিল পণ্য উত্পাদনে সক্ষম, তা পরিমাপ করে। এই সূচকে চীন ১.৪, ভারত ০.৫ এবং ভিয়েতনাম ০.২ স্কোর অর্জন করেছে, যেখানে বাংলাদেশ -০.৭ স্কোর করেছে। এছাড়াও, বাংলাদেশ তৈরি পোশাকশিল্প খাতে দ্বৈত কেন্দ্রীকরণ সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আসছে। দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ তৈরি পোশাক খাত থেকে আসে, কিন্তু এই মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সুতির পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। সুতির পোশাক তৈরির কাঁচামাল তুলা, যা বাংলাদেশ বিনা শুল্কে আমদানি করতে পারে। তবে মানবনির্মিত তন্তুর ক্ষেত্রে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়, যা এই তন্তুর তৈরি পোশাকের উত্পাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়। ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত শুল্কনীতি বাংলাদেশের এই সমস্যাকে আরো ত্বরান্বিত করতে পারে।
যখন মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ বৈশ্বিক বাজারকে অস্থির করছে, তখন বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে। উত্তরণের পর বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা হারাবে, যা বর্ধিত শুল্ক ও আরো কঠোর রুলস অব অরিজিনের মতো নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে। বর্তমানে বাংলাদেশ একক-পর্যায়ের রূপান্তর সুবিধা পাচ্ছে, যেখানে বিদেশ থেকে কাপড় আমদানি করে দেশে পোশাক তৈরি করে তা রপ্তানি করা সম্ভব। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর দ্বৈত-পর্যায়ের রূপান্তরের শর্ত পূরণ করতে হবে, যার অধীনে রপ্তানিযোগ্য পোশাক তৈরির জন্য দেশেই কাপড় উত্পাদন করতে হবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত শুল্কনীতি বাংলাদেশের জন্য মিশ্র প্রভাব ফেলতে পারে। তাই বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ যথাযথ নীতি প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন জরুরি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক পোশাকশিল্পে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখতে এবং নেতৃত্বের অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
লেখক : সিনিয়র গবেষণা সহযোগী, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট