অর্থই অনর্থের মূল— এই বাক্যের সঙ্গে স্কুলজীবন থেকেই আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। কেননা, এটি পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রে ভাবসম্প্রসারণ করার জন্য প্রশ্নে থাকত। আসলে এটি প্রচলিত এবং চিরায়ত একটি উক্তি।
আসলেই কি তাই—‘অর্থই অনর্থের মূল’? জীবন ধারণের জন্য অর্থের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এটা অস্বীকার করার কি কোনো উপায় আছে? তবে সহজ, সরল ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবনযাপনের জন্য খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন হয় না। সুতরাং ন্যূনতম সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থসম্পদই মানুষের জীবনে শান্তি নষ্ট করে। কেন বলছি একথা, যার টাকা আছে সে আরো টাকা চায়। যার নেই তার চাহিদাও কম। এ পৃথিবীতে অতিরিক্ত চাওয়াই মূলত সব দুঃখের মূল কারণ। তাই যার চাওয়া কম, তার দুঃখও কম। আরেকটি কথা, আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ অদৃষ্টবাদিতায় বিশ্বাসী। তাই যার যা আছে সে তাতেই তৃপ্ত থাকে। সে সুখী বলেই সন্তুষ্ট থাকে। তাই তো তার সুখ মুঠো-মুঠো ভরা থাকে। ফলে টাকার জন্য হাপিত্যেশ করা গড়পড়তায় লোকের সংখ্যা কম। ফলে তাদের মনের শান্তিও সদা বিরাজমান।
তাই সঙ্গত কারণে বলা যায়, আমাদের সুখী করে সেটা টাকা নয়। বিত্তবৈভবও নয়। বরং সুখ নির্ভর করে মানুষের চাহিদার পরিমাণ বা সীমানা বা গণ্ডির ওপর। কেননা, চাহিদা বাড়লে তাদের অভাববোধ তৈরি হয়। এতে যা আছে তাতে সে তৃপ্ত থাকতে পারে না। ফলে আরো বেশি পাওয়ার অস্থিরতা তাকে বিব্রত করে। অসুখী করে। এতে যা আছে তাও সে ভোগ করতে পারে না। কারণ, এ অভাববোধ তখন রোগের কারণ হয়ে ওঠে।
পৃথিবীতে কোন দেশের মানুষ সবচেয়ে সুখী? একটা আন্তর্জাতিক জরিপে বলা হয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী বাংলাদেশের মানুষ। কী দারুণ ব্যাপার! অর্থ, যশ, ক্ষমতা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির কোনো শেষ সীমারেখা নেই। যার যত আছে আনুপাতিকহারে ততই তার চাহিদা বাড়ে। তাই সুখী লোকের চেয়ে দুঃখী লোক এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অর্থবিত্তের মাপকাঠি দ্বারা সমাজে আজ ব্যক্তির যশ, প্রতিপত্তি ও সম্মান নির্ণীত হচ্ছে যা কাম্য নয়। এটাও অসুখের অন্যতম কারণ। তার স্থলে জ্ঞানী ও নীতিবান মানুষকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
জীবন ধারণের জন্যে নিঃসন্দেহে অর্থ-খ্যাতি বা বস্তুর প্রয়োজন আছে। তবে এর সীমা বা গণ্ডিটাকে জানতে হবে। এক্ষেত্রে হযরত জালালউদ্দিন রুমীর চমত্কার একটা উপমা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘নৌকা চলার জন্য পানি অত্যাবশকীয়। কিন্তু এই পানি যখন নৌকার ভেতরে প্রবেশ করে তখন নৌকাডুবি ঘটে।’ অর্থাত্ অর্থ, খ্যাতি বা বস্তুর পেছনে যখন কেউ মোহগ্রস্তের মতো ছোটে, তখনই তার আত্মিক মৃত্যু ঘটে। দেহের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাটের মতো জীবনের অন্যান্য সবকিছুতেও প্রয়োজনের একটা সীমা আছে। বেশি হলেই তা বিপজ্জনক। তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাহিদা অবদমিত করা অত্যাবশ্যক।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেছেন, একটা অসম্ভব সুন্দর, অসম্ভব আনন্দে ভরা, সৌন্দর্যে ভরা আলোয় ভরা একটা জীবন আমাদের। সুতরাং এরকম দুর্লভ একটা জীবন পেয়েও আমাদের কতনা দুঃখ, কত না দীর্ঘশ্বাস! এটা হলো না, ওটা পেলাম না। আরো কেন হলো না? কিছুতেই যেন সাধ মেটে না। এই যে অপূর্ণতা, এই যে তৃষ্ণা এটাই জীবনের অর্থপূর্ণতা বুঝতে হবে। তাই এখন থেকে জীবনটাকে আর অবহেলা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য নয়।
পৃথিবীতে ভালোমন্দের সহবস্থান আগেও ছিল, এখনো আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। এ নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবে ভালো মানুষ তৈরি করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে আমাদেরই। শুরুটা করতে হবে শিশুর পারিবারিক পরিবেশ থেকে। এজন্য প্রয়োজন পারিবারিক পরিমণ্ডলে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চার নিবিড় কার্যক্রম। আরো চাই সঙ্ঘবদ্ধ উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা। আসলে মানুষের জীবনে প্রয়োজনীয় একটি গুণ তা হচ্ছে পরিমিতিবোধ। পরিমিতি মানে হচ্ছে জীবনে সবকিছুরই প্রয়োজন আছে কিন্তু নিজের সীমাটা বুঝতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, কুরআনে মধুকে শেফা হিসেবে বলা হয়েছে। এখন এটা মনে করে যদি আমরা এক লিটার মধু একবারে খেয়ে ফেলি, তাহলে অবধারিতভাবেই সেটি সুখকর হবে না। পরিমিতি মানে হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণ। সুতরাং শৈশব থেকেই শিশুদের আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে অভ্যস্ত করতে হবে। তবেই এটা চাই, ওটা চাই এই অপ্রয়োজনীয় চাওয়া থেকে তারা বিরত থাকবে।
বিদ্যালয়গুলোতে কেবল ক্লাসভিত্তিক ছাত্র-শিক্ষক যোগাযোগ নয়, বাড়াতে হবে প্রত্যক্ষ মানবিক যোগাযোগ। তাছাড়া বিদ্যালয়গুলোতেও সত্, যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকতে হবে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যাসেম্বলিতে নৈতিক মূল্যবোধ চর্চা করা অত্যাবশ্যক। কারণ, ভালো রেজাল্ট করার চেয়ে ভালো মানুষ হওয়া বেশি জরুরি। এর জন্য চাই সন্তানের ভ্রূণ অবস্থা থেকেই পরিবারে প্যারেন্টিংয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা। আমাদের মূল কথা হলো পরিমিতিবোধ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ হোক আমাদের পথচলার অনুষঙ্গী।
আসুন, আমরা দৃষ্টিভঙ্গি পালটাই। পরিবারের সবাইকে পরিমিতিবোধ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের দীক্ষায় দীক্ষিত করে গড়ে তুলি। তবেই দেশ হবে উন্নত ও সমৃদ্ধ।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক