আমরা পর্যবেক্ষণ করে আসছি যে, উন্নয়নশীল দেশসমূহের রাজনীতিতে গুন্ডা, মাস্তান, অশিক্ষিত, ইয়াবা বা মাদক ব্যবসায়ীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া এবং তাদের মাধ্যমে দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে যখন কারো পতন হয় ন্যক্কারজনকভাবে, তখন ১০ মিনিটের জন্য হলেও একান্তে এটা নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। তারা এমন কী করেছেন যে, এই জন্য আজ তাদের এমন করুণ পরিণতি বরণ করতে হলো! কেন সকল সিস্টেম ব্যর্থ হলো? মাস্তান ও গুন্ডা বাহিনী কোথায় গেল? এতো বড় সংগঠন, কী হলো তার? তাদের এতো প্রভাব-প্রতিপত্তি কোথায় গেল? এতে কি বোঝা যায় না যে, একটি রাজনৈতিক দলের আদর্শিক ভিত্তি মজবুত থাকা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?
উন্নয়নশীল দেশে রাজনীতিকে রাজনীতি হতে বিতাড়িত ও বিতর্কিত করে কার কী লাভ? দলে মাস্তানতন্ত্র বা চোরতন্ত্রের প্রশ্রয় দিয়ে ক্ষতিটা শেষপর্যন্ত কার হয়? ভাবতে হবে, রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করার পরিণাম কতোটা ভয়াবহ হয় কিংবা হতে পারে। সাধারণ মানুষ যখন চোখের সামনে দেখে— ক্ষমতাসীনরা আইন ভঙ্গ করছে; মাস্তানি, চাঁদাবাজি বা দখলবাজিতে লিপ্ত রয়েছে, তখন তারা আশাহত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেবেই। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ তাদের কিছুই করতে পারে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা প্রভাবশালীদের সাথে যোগসাজশ রক্ষা করে চলে। একটি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দলীয়করণের পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য। তাই শুধু হাঁ-হুতাশ প্রকাশ বা গালাগালি করলেই চলে না, এ ব্যাপারে আত্মজিজ্ঞাসা ও সংশোধনই সবচাইতে বড় প্রয়োজন। এদিক হতে এই সকল দেশের সেনাবাহিনী অনেক সময় কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। ফলে তারা সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকতে পারে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশে অভ্যুত্থান, পালটা অভ্যুত্থান কত কী ঘটে! এভাবে পরিবর্তন তো নতুন কোনো বিষয় নয়; কিন্তু প্রশ্ন হলো, বারংবার কেন এমন ঘটনা ঘটে? এর কারণ, সম্ভবত ইতিহাস হতে আমরা কেউ শিক্ষা গ্রহণ করি না। তাছাড়া উন্নয়নশীল দেশের মানুষের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র্য ও অভাব-অনটন এবং অসচেতনতাও বহুলাংশে দায়ী। দেশ পরিচালনায় সিস্টেম বা পদ্ধতিগত অনুন্নয়নের কারণে গোটা দেশ ও জাতিকে ভুগতে হয়। তাই একটু সময় নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন, এই সকল দেশে মাদক ও চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্যের পেছনে আসলে কারা দায়ী? কারা টেন্ডারবাজি করে? কারা কাজ না করেই বিল তুলে নেয়? কেন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, সুপার ইঞ্জিনিয়ার বা চিফ ইঞ্জিনিয়াররা এর কোনো প্রতিকার করতে পারেন না বা করেন না? কারা ব্যাংক লোপাট করে? যদি মনে করা হয় যে, এই ব্যাপারে দেশের সকলেই বেখবর ও বেওয়াকিবহাল, তাহলে তাহা ভুল হবে। তাছাড়া চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে হবে কেন? অন্যদিকে, একজন মানুষের কত সম্পদ দরকার?
অতএব, এই সকল দেশে হতদশার কারণগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন। নেতাদের ভাবা প্রয়োজন, কোথায় কোথায় তারা ভুল করেছেন বা করছেন। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগের দলীয়করণও কেন একসময় কোনো কাজে আসে না। কেন গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সুশাসন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে বারংবার জীবন উৎসর্গ করতে হয়? উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশসমূহে এই আত্মজিজ্ঞাসাই আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। শুধু রাজনীতিবিদদেরই নয়, প্রত্যেক মানুষের উচিত নিজের কৃতকর্ম বা পরিণতি নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও একাগ্রচিত্তে চিন্তা করা। যদি কোনো ভুলভ্রান্তি থাকে, তাহলে তা শোধরানো উচিত। এজন্য অন্যদেরও সতর্ক হতে হবে, যাতে তাদেরও অনুরূপ করুণ পরিণতি বরণ করতে না হয়। কেননা এই আত্মজিজ্ঞাসাই মানুষকে পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ করে গড়ে তুলতে পারে।