জ্ঞান কখনো নির্দিষ্ট সীমানায় গণ্ডিবদ্ধ নয়, বরং এটি নির্দিষ্ট চিন্তায় গণ্ডিভুক্ত মানুষের চিন্তাশক্তি সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়, যেখানে শিক্ষার একেকটি স্তরে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে পাঠদানের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা যায়। ফলে সেই জ্ঞান নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে আবদ্ধ থাকায় বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের বাইরে চিন্তাভাবনার পরিসর বাড়ার সম্ভাবনা তেমন একটা থাকে না! বৃহৎ পরিসরে তা প্রসারিত ও প্রতিফলিত হতে পারে না।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই ছাড়া অন্যান্য উত্স থেকে জ্ঞানার্জন করার প্রশ্নে এখনো অনেকটা পিছিয়ে। এভাবে পাঠ্যবইয়ের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের বই পাঠের আগ্রহ না থাকায় এটি সৃজনশীল ও চিন্তাশক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা বই মানুষের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনার উৎপত্তিস্থল।

বর্তমানে ভালো ফলাফলের আশায় শিক্ষার্থীরা কতটা পাঠ্যবইকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে, তা দেশে কোচিং সেন্টারের অতি বৃদ্ধির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এতে করে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে গবেষণা ও উদ্ভাবনী থেকে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং-২০২৫-এর তালিকার সেরা ১ হাজারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান পায়নি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান তালিকার ৮০০-এর মধ্যে। এই রাংকিং থেকে বাংলদেশে গবেষণার গুণমান ও পরিবেশ সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
গবেষণায় মৌলিক বিষয় ও প্রকাশনা পর্যাপ্ত না থাকায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। এই অবস্থার উত্তরণ জরুরি। জ্ঞান যাতে কেবল পাঠ্যবইভিত্তিক হয়ে না পড়ে, সেজন্য জানার আকাঙ্ক্ষা, উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা, যুক্তি ও তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞানের প্রসার ঘটানোর বিষয়ে জোর দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের নতুন বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা ও সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াকে আরো সহজ করে তুলতে পারেন শিক্ষকরা। সেই সঙ্গে বাবা-মা সন্তানের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে যেহেতু গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখেন, তাই তারা শিক্ষার্থীর মেধা ও সৃজনশীল প্রতিভা অগ্রগতির পরিবেশ তৈরির কাজটি করতে পারেন খুব সহজেই।
প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানভিত্তিক ও গবেষণামূলক মনোভাব তৈরি করতে বাবা-মা, তথা পরিবারকেই দায়িত্ব নিতে হবে। বইমেলা, বিজ্ঞান মেলা, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতাতে বাচ্চাদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে তা করা যেতে পারে, যা মেধা বিকাশে অত্যন্ত কার্যকরী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চা ও মুখস্থবিদ্যা থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে শিক্ষার্থীর দক্ষতা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও অনুপ্রেরণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্ভাবনী মনোভাব তৈরিতে সাহায্য করবে।
শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইকেন্দ্রিকতা যেন তাদের মেধা বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে না ওঠে, সেদিকে লক্ষ রাখা আবশ্যক। প্রয়োজন সৃষ্টিশীল চিন্তা চিন্তাভাবনা। এভাবে একজন মানুষকে শিশুকাল থেকেই পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞানী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। সুতরাং, শিক্ষার্থীদের উচিত হবে, পাঠ্যবইয়ের বাইরে নিয়মিত অন্যান্য বই পড়া।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়