সম্প্রতি ১১ বছরের সুবার করুণ গল্প সমাজের প্রতিটি স্তরকে নাড়া দিয়েছে। মায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসা এই কিশোরী টিকটকে এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নওগাঁয় পালিয়ে যায়। পুলিশের উদ্ধার অভিযান, ভিডিও বার্তা এবং পরিবারের হাহাকার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—অপরিণত বয়সে ডিজিটাল ডিভাইসের অসচেতন ব্যবহার শিশুদের কীভাবে বিপদের গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে। সুবার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি ডিজিটাল যুগের অভিভাবকত্বের জটিলতা এবং সমাজের সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
এ রকম ঘটনায় স্পষ্ট হয়, সামাজিক মাধ্যমের অদৃশ্য থাবা শিশুদের মানসিকতাকে কীভাবে বিকৃত করে। টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে অপরিচিতদের সঙ্গে সহজ সংযোগ, রোমান্টিক সম্পর্কের ভুল ধারণা এবং গোপনীয়তা রক্ষায় ব্যর্থতা বিপদকে আমন্ত্রণ জানায়। এখানে প্রশ্ন জাগে—শিশুর হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দেওয়ার আগে অভিভাবকরা কি ডিজিটাল জগতের নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন?
এই সংকট মোকাবিলায় প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার। অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএস ডিভাইসে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যম, সার্চ হিস্ট্রি এবং অ্যাপ ডাউনলোড নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পাশাপাশি দিনে ১-২ ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন টাইম না দেওয়া এবং রাতের বেলা ডিভাইস ব্যবহারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জরুরি। তবে কেবল নিষেধই যথেষ্ট নয়। শিশুর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে ডিজিটাল নিরাপত্তার গুরুত্ব বোঝানো দরকার। যেমন—অনলাইনে অপরিচিত কেউ কথা বলতে চাইলে কী করবে? এমন প্রশ্নের উত্তর যেন তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দিতে পারে।
ডিজিটাল ডিভাইসের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে ইতিবাচক বিকল্প গড়ে তুলতে হবে। অমর একুশে বইমেলা এমনই একটি সুযোগ। শিশু-কিশোরদের জন্য রচিত সাহিত্য, বিজ্ঞানবাক্স বা গল্পের বই উপহার দিয়ে তাদের জগৎকে সমৃদ্ধ করুন। প্রতিদিনের পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আম আঁটির ভেঁপু’ যেমন প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের মিলকে ফুটিয়ে তুলবে শিশুদের ভাবনার জগতে, তেমনি চাঁদের পাহাড় কল্পনার জগতে রং ছড়িয়ে করবে সমৃদ্ধ। শুধু বই নয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও শিশুদের বাস্তব জগতের সঙ্গে যুক্ত রাখে। নাচ, গান, আবৃত্তি বা নাটকের কর্মশালায় অংশ নিয়ে তারা সৃজনশীলতার স্বাদ পায়। এসব কার্যক্রমে শিশুদের সময় দেওয়া মানে তাদের মনোযোগ ডিজিটাল স্ক্রিন থেকে সরিয়ে প্রকৃত সৌন্দর্যের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। এভাবে মোবাইল ফোনের প্রতি তাদের আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
পারিবারিক বন্ধনও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সুবাদের পরিবার যখন মায়ের চিকিৎসা নিয়ে ব্যস্ত, তখন তার মানসিক সঙ্গী হয়ে উঠেছিল একটি মোবাইল স্ক্রিন। এই ফাঁকা সময়গুলো পূরণ করতে পারত বই বা পারিবারিক আড্ডা। সন্তানের মানসিক চাহিদা বোঝা এবং তা পূরণ করা অভিভাবকদের দায়িত্ব। সপ্তাহে অন্তত একদিন সমবয়সিদের সঙ্গে খেলাধুলা বা পারিবারিক আউটিং-এর ব্যবস্থা করা, ডিজিটাল ডিটক্স ডে চালু করা—যেদিন পুরো পরিবার মোবাইল বন্ধ রেখে প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাবে—এসব ছোট ছোট উদ্যোগই বদলে দিতে পারে শিশুর জীবন।
ডিজিটাল অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার আগেই শিশুদের হাতে তুলে দিতে হবে আলোর মশাল। বইয়ের পাতায় পাতায় লুকিয়ে আছে জ্ঞানের ভান্ডার, আর সংস্কৃতির চর্চা দেবে আত্মবিশ্বাসের পাথেয়। মোবাইল ডিভাইস যেন শিক্ষা ও যোগাযোগের মাধ্যম হয়, বিপদের ফাঁদ নয়।
পরামর্শ :
বইমেলায় শিশুকে নিয়ে ঘুরে দেখুন। তার পছন্দের বইটি কিনে দিন। স্থানীয় লাইব্রেরি বা সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে যুক্ত করুন। সপ্তাহে এক দিন ‘ফ্যামিলি গেম নাইট’ চালু করুন—লুডু, দাবা বা গল্প বলার প্রতিযোগিতা হোক আনন্দের হাতিয়ার।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত। এ সংক্রান্ত যাবতীয় দায়ভার লেখকের ওপর বর্তাবে এবং এর জন্য দৈনিক মূলধারা কোনোক্রমেই দায়ী নয়। )