যুদ্ধ পৃথিবীর এক ভয়াহব বাস্তবতা। আমরা যতদূর পর্যন্ত মানবজাতির অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারি, তার অনেকাংশ জুড়ে রয়েছে যুদ্ধের ইতিহাস। সভ্যতার ক্রান্তিলগ্ন হতে এ পর্যন্ত মানুষ যতটা সভ্য হয়েছে, তাদের জীবনযাত্রার মান ততই উন্নত হয়েছে; কিন্তু এর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে যুদ্ধ আরো বেশি বিধ্বংসী ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। তবে একটা বিষয় পরিবর্তন হয় নি একটুকুও; আর তা হলো, মানুষের নীতিগত স্বার্থ। আগের মতো এখনো পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধ বাধলে যুদ্ধরত দুই পক্ষের বাইরে তৃতীয় আরেকটা পক্ষ থাকে, যাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের জীবন বিপন্ন করতেও দ্বিধাবোধ করে না! এর বিপরীত চিত্রও আছে। মানবতার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে পিছপা হন না অনেকে। বর্তমানে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, সেখানেও ঠিক এমন একটি চিত্রই দেখা যাচ্ছে। একদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যুদ্ধাহত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে; অন্যদিকে কিছু অনৈতিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই সুযোগে মানুষ পাচারের মতো ঘৃণ্য কাজে লিপ্ত হয়েছে। দুঃখজনকভাবে সেটি আবার ঘটছে আমাদের দেশেই। কী সাংঘাতিক কথা! বলে রাখা দরকার, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আমাদের, তথা বাংলাদেশের কোনো নীতিগত স্বার্থ নেই। কিন্তু তার পরও এই যুদ্ধ ঘিরে উপরিউক্ত ঘটনার অবতারণা; অর্থাৎ, এই যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
পত্রিকা মারফত জানা যায়, ১০ জন বাংলাদেশি যুবককে সৌদি আরব নিয়ে সেখান থেকে আবার রাশিয়ায় পাচার করা হয়েছে। তাদেরকে ‘চকলেট কারখানা’, ‘ফুলের বাগানের কাজ’ বা ‘নিরাপদ পেশার’ কথা বলে উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে। গভীর উৎকন্ঠার বিষয় হলো, রাশিয়ায় নিয়ে ১৫ দিনের নামমাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে তাদের। এর চেয়েও উদ্বেগজনক কথা, এ প্রক্রিয়ায় যারা যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান রাখেন না কিংবা যারা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বাধার সম্মুখীন হন, ছাড় দেওয়া হয়নি তাদেরকেও! ফলে তারা উপায়ান্তর না দেখে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনটা করার কারণ কী? এর মাধ্যমে মূলত তাদেরকে যুদ্ধে আহত বা নিহতের সংখ্যা কৌশলগতভাবে বৃদ্ধি করার এক প্রক্রিয়াকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাবা যায় এই দৃশ্য! এই প্রবণতা কেবল আমাদের দেশের নাগরিকদের জীবনকেই বিপদগ্রস্ত করছে না, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে জাতি হিসেবে আমাদের সম্মানকেও কলঙ্কিত করছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউরোপ ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা করছে; অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়া সেনা সহযোগিতা দিচ্ছে রাশিয়াকে। তাদের এমন পদক্ষেপের পেছনে স্বার্থান্বেষী ছোঁয়া বিদ্যমান। তবে বাংলাদেশের সরাসরি কোনো নীতিগত স্বার্থ না থাকলেও, কিছু অসাধু চক্র ‘চাকুরি’ দেওয়ার নামে দেশের সহজ-সরল মানুষজনকে অবৈধভাবে ঠেলে দিচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে। অবিলম্বে এদের থামাতে হবে। এর সঙ্গে জড়িত সকলকে শাস্তির মুখোমুখী করতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার যখন ইহুদিদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছিল, তখন অস্কার শিন্ডলার নামের এক জার্মান ব্যবসায়ী নিজের অর্থ দিয়ে ইহুদি ক্রয় করে তাদের মুক্ত করে দিতেন। এমনকি তিনি তাদের মুক্তির জন্য একটি কারখানা খুলে তাদের কাজের ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দেন, যাতে কাজ করানোর মাধ্যমে তাদের বাঁচানো সহজতর হয়, মুক্তির সুযোগ নিশ্চিত করা যায়। পৃথিবীর প্রায় সকল যুদ্ধের সময়ই যখনই সংকট তৈরি হয়েছে, তখনই সত্ মানুষেরও আবির্ভাবও ঘটিয়াছে। সেই সকল মানুষের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, সংকটময় মুহূর্তে মানুষের উদারতা কতিপয় অনৈতিক গোষ্ঠীর লোভের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়ায়।
যুদ্ধ চলাকালীন মানবতার সংকট একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কারণ, যুদ্ধ কেবল রণক্ষেত্রেই নয়, ভিন্ন কোনো ভূখণ্ডেও সংকট তৈরি করতে পারে। আমাদের দেশে সেই সংকট-ই তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত এ সব অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা। শুধু সরকার নয়, এ ধরনের কার্যকলাপ প্রতিহত করতে সমাজের প্রতিটি স্তরে ব্যক্তি পর্যায়েও সচেতন থাকা অতীব জরুরি।