তুমুল জনপ্রিয় শব্দ ‘ভাইরাল‘। এই শব্দটির সঙ্গে আমরা এখন সবাই ব্যাপকভাবে পরিচিত। অবশ্যই সেটা স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে। ‘ভাইরাল‘ শব্দটির বাংলা অর্থ— ছড়িয়ে পড়া। প্রায় নিত্যদিন ফেসবুকে অথবা ইউটিউবে পোস্ট দেখা যায়—‘আজকের ভাইরাল গান, ভাইরাল ভিডিও’ ইত্যাদি। আর এই ভাইরালের নেশায় পড়েছে আমাদের তরুণ সমাজ থেকে শুরু করে শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধরাও। ভাইরাল আর ফেমাস বা জনপ্রিয়তা শব্দের মধ্যে তফাতটাই আমরা ভুলে গেছি। আমরা চাইছি যেমনভাবে হোক, মানুষ আমাদের চিনবে। কিন্তু চিনে সম্মান করবে নাকি ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখবে তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। ভাইরাল হতে চাওয়া বর্তমানে একটি রোগে পরিণত হয়েছে।
এই যে কয়েক দিন আগে ১১ বছরের মেয়ে সুবা তার বিশেষ বন্ধুর সঙ্গে বাবা-মাকে না বলে পালিয়ে গেল। সে বলল, তাদের পরিচয় হয়েছে ‘টিকটক’-এ। টিকটক বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম ভাইরাল একটি অ্যাপ। ভাইরাল হওয়ার নেশা যে কতটা আসক্ত করে দেয় মানুষকে, তা আমি নিজে বুঝি। কারণ একসময় আমিও এসব তথাকথিত ট্রেন্ডের নেশায় আসক্ত ছিলাম। কিন্তু আমার সৌভাগ্য যে, আমার পরিবার আমাকে মারধর না করে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেছেন এসবের কুফল। তারপর থেকে আমি আস্তে আস্তে বুঝতে শিখেছি, আসলে এই ভাইরাল হতে চাওয়ার নেশা কতটা ভয়ানক! তরুণ থেকে শুরু করে শিশু-বৃদ্ধরাও এই ভাইরাল হতে চাওয়ার নেশায় উদ্ভট অশ্লীল ভিডিও বানাচ্ছে। আর এর জন্য তারা ভাইরালও হচ্ছে। তাদের কমেন্ট বক্সে মানুষের গালাগালি দিয়ে ভর্তি। কিন্তু এতে তারা বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়। এর কারণ হলো টাকা। কনটেন্ট তথা ভিডিও যেমনই হোক, শুধু ভিউজ হলেই আপনার অ্যাকাউন্টে ঢুকবে ডলার।

আসলে আমরা জাতি হিসেবেও এমন যে, কেউ ভালো কিছু করলে তার দিকে চেয়েও দেখি না, প্রশংসা করা দূরের কথা। আর কেউ খারাপ কিছু করলে তাকে চিনে না থাকলেও দুটো গালি দিয়ে আসি। ভালো কনটেন্ট যে কেউ বানায় না, তা কিন্তু নয়। টিকটকে বলুন বা অন্যান্য স্যোশাল মিডিয়া ফেসবুক পেইজ বা ইউটিউব বলুন, এমন অনেক ক্রিয়েটর আছেন, যারা অনেক ভালো তথ্যবহুল, শিক্ষণীয় ভিডিও বানান। কিন্তু তুলনা করলে দেখা যাবে, যারা উদ্ভট ভিডিও বানায়, তাদের ভিডিওর ভিউয়ের অর্ধেকও ভালো ভিডিওগুলোয় নেই। এজন্য মানুষ উৎসাহ হারিয়ে ফেলে ভালো কিছু ক্রিয়েট করার।
আসলে খারাপ কনটেন্টগুলো যে আমরা দেখতে চাই, তাও নয়। যখন সামনে উদ্ভট ভিডিওগুলো আসে, তখন রাগের বশে সবাই কমেন্টে গালিগালাজ করে। ব্যাস এতেই ভিডিওর রিচ বেড়ে যায় এবং তথাকথিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের এতেই লাভ। কয়েকটা ভিডিও ভাইরাল হলেই তারা লাখপতি হয়ে যাচ্ছে। এসবের কুপ্রভাব পড়ছে যুবসমাজের ওপর।
যেখানে প্রায় ২৫ বছর বাবা-মায়ের কষ্টের টাকায় পড়াশোনা করেও চাকরির নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। লাখ লাখ টাকা খরচ করে লেখাপড়া শেষে মাসে ২০ হাজার টাকার চাকরি পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে যায়। সেখানে কোনোরকম পরিশ্রম ছাড়াই অশ্লীল ও উদ্ভট ভিডিও বানিয়ে ভাইরাল হয়ে বছর ঘুরতেই লাখপতি হয়ে যাচ্ছে এমন সব মানুষ, যারা জীবনে স্কুলেও যায়নি! এসব দেখে যুবসমাজের মনে প্রশ্ন জাগছে, তাহলে পড়াশোনা করা কি পণ্ডশ্রম? যার ফলে একদিকে ভাইরাল হওয়ার নেশায় অন্যদিকে বিনা পরিশ্রমে লাখপতি হওয়ার চিন্তায় মানুষ মেতে উঠেছে এসব ভিডিও বানানোর অস্বাভাবিক উত্সবে! টিকটক প্ল্যাটফরম মোটেই খারাপ বলছি না। যে কোনো প্ল্যাটফরম ভালো কি খারাপ তা নির্ভর করে মানুষ তাকে কীভাবে ব্যবহার করে, এর ওপর। কিন্তু আফসোস টিকটকের ভালো ব্যবহার আজ অবধি দেখা যায়নি। বরং এই টিকটক ও এ জাতীয় অ্যাপসগুলো ব্যবহার করে সামাজিক অবক্ষয় দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি নারী পাচারের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এসব অ্যাপসের মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক দিক নিয়ে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি অনেক কথাই বলেছেন; যেমন—কাল নিউপোর্ট (Cal Newport) বলেছেন :‘সামাজিক মাধ্যম ডিজাইন করা হয়েছে আপনার মনোযোগ চুরি করার জন্য, তাই এটি ব্যবহারের আগে ভেবে দেখুন, আপনি কাকে বেশি মূল্য দিচ্ছেন—আপনার সময়, নাকি অন্যের ব্যবসার লাভ?’
এদিকটি বিশেষভাবে চিন্তা করা জরুরি। টিকটকসহ এধরনের অ্যাপসগুলো নিষিদ্ধ করা যায় কি না, তা নিয়ে এখনই চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। এটি এখন সময়ের দাবিও বটে। নয়ত আমাদের যুবসমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক : শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়