জায়েদ (ছদ্মনাম) : আর কতো? এখন না হয় একটু প্রশান্তি খোঁজে দূরে যাওয়া যাক।
বন্ধু : আমাদের বিভাগ থেকে তো শিক্ষা সফরে আগে যাওয়া হয়নি। কোথায় যাওয়া যায়?
জায়েদ : সিলেট, রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার…..।
বন্ধু : যেহেতু বিভাগের শিক্ষা সফর, তাই সবার মত নেওয়া প্রয়োজন।
এভাবে আলোচনার দ্বি-টানাপোড়েনে দ্বারস্থ হতে হলো শিক্ষকদের কাছে। তাঁরা বললেন, তোমরাই এই আয়োজনের মূল প্রাণ। আলোচনা কর এবং সিদ্ধান্ত নাও। আমরা তোমাদের সাথে আছি। ঠিক এ রকমভাবেই শুরু হয় প্রথম শিক্ষা সফরে যাওয়ার পরিকল্পনা।
মানুষ সাধারণত নিজের জীবনের কোনো এক অধ্যায়ের প্রথম ও শেষ স্মৃতি রোমাঞ্চকর করে তুলতে চায়। আর তাই প্রথম শিক্ষা সফর হিসেবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগের ২০-২১, ২১-২২, ২২-২৩ ও ২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আলোচনা সাপেক্ষে স্থান ঠিক করা হলো— পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ‘কক্সবাজার’।
সাংবাদিকতা বিভাগের ছোট্ট এই পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দূরের সফরে পরিবার ও নানা প্রতিকূলতার প্রতিবন্ধকতা কাঁটিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ খোশ গল্প মেতে উঠছে, তো কারো আড্ডার প্রধান আলোচনাই ভ্রমণ। এভাবে যাত্রার আগে থেকেই সদস্যদের মধ্যে আনন্দের প্রাণ সঞ্চারিত হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে দিন যতই ঘনিয়ে আসে, আনন্দঘন মুহূর্ত উদ্বেল হয়ে ওঠে ততই! অবশেষে সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসহ তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিজয় ৭১’ বাসে শুরু করে শুভযাত্রা। সবার মধ্যে একই ধরনের অনুভূতি— আমাদের প্রথম শিক্ষা সফর শেষমেষ বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। এই অনূভুতির ভাব যেন শেষ হওয়ার নয়।
দীর্ঘ সাড়ে ১৫ ঘণ্টা যাত্রার পর সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বঙ্গোপসাগরে নোঙর করে আমাদের যাত্রা-তরী। সাগরের সুনীল জলরাশির গর্জন আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে দেখে আপ্লুত হয়ে পড়ে সবাই। সে এক অন্য রকম অনুভূতি!
কারো কাছে প্রথম, কারো কাছে পুরোনো রূপ নতুন করে সমুদ্র দেখা। সাগরের এই বিশাল জলরাশি ও গর্জন শুনে ছোট-বড় সকলেই যেন হারিয়ে গেল শৈশবের রূপে! আকাশের দিকে তাকিয়ে অসীম প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি চোখ পাশাপাশি সাগরের বুকে বারবার ঢেউয়ের আঁছাড়, গর্জন, দক্ষিণের বাতাসের ঝাপটা জীবনের এক অমোঘ বাণী সঞ্চারিত হয়— এই হলো সাগরের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। সাগরের এই বিশালতাই মনে করে দেয়— সাগর কেন সবার স্বপ্ন ও পছন্দের তালিকায় থাকে। লেখকের গল্প, কবিতা, উপন্যাসে স্থান করে নেয়।
সাগরের নোনা পানিতে ডুব দেওয়া, ফুটবল খেলা, কাউকে চোবান, ফোটবন্দি, কেউ-বা সাগরের কিনারায় খোঁজে ছুটে চলেছে দূর-দূরান্তে! এভাবেই কেটে যায় ঘন্টাখানেক। পরে বিকেলে আবার দলবদ্ধভাবে সাগর দেখতে যায় সবাই। সাগরের নোনা জলের সেই উদ্দাম নৃত্য কখনোই ভোলার নয়।
অনেকে সাগরে ডুবন্ত সূর্য খুব কাছ থেকে দেখার জন্য ছুটে যায়। সূর্য অস্তের সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে, তত আকাশের কালো আভা বিস্তার লাভ করছে। সেই সাথে সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া, অক্টোপাস খাওয়ার লোভ ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশেষে সবাই পছন্দের মাছ, কাঁকড়া ইত্যাদি বারবিকিউ, ফ্রাইসহ নানা ঢঙে খাবার উপভোগ করে। খাবারের পর গভীর রাতে কালো আকাশের নিচে নিজেকে ও সাগরকে একই ধ্যানে রাখতে পৃথিবীর যান্ত্রিক জীবন থেকে খানিকটা সময় বিচ্ছিন্ন রাখতে রহস্যময়ী সকল ভাবনায় হারিয়ে যেতে চায় এসময়।
রাতের আধো ঘুম, ক্লান্ত শরীর মনের আনন্দ ঘন অসীম শক্তির কাছে হার মেনে পরদিন সবাই আবারো জাগ্রত হয় নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্য। হোটেলে সামনে থেকে ৩টি চাঁদের গাড়িতে করে আবারো যাত্রা শুরু। একপাশে বন ও ছোট ছোট পাহাড়, নারিকেল বা ঝাউ গাছ অপরদিকে নীল জলরাশি, সাম্পান নৌকা এরই মাঝে গড়ি ছুটছে পৃথিবীর দীর্ঘতম মেরিন-ড্রাইভ সড়ক দিয়ে। এবার আমাদের প্রথম গন্তব্য পাটুয়ার টেক। কারো মুখে পছন্দের গান, কারো চোখে আনন্দে ঢেউ খেলা করছে। পাটুয়ার টেক হলো— বড় বড় পাথুরে গাথা বিশাল সাগর আর অন্য পাশে পাহাড়ের বিস্তৃতি। সাগরের পানি বারবার আঁছড়ে পড়ছে পাথরের ওপর। প্রকৃতি এই অপার সৌন্দর্যের নিজেদের ফটোবন্দি করতে কেউ ভুলেনি। একঘণ্টা বিরতির পর চাঁদের গাড়ি আবারো ছুটে চলল ইনানী বিচের উদ্দেশ্য।
সৈকত জুড়ে প্রবাল পাথরের সর্বাঙ্গ জুড়ে থাকে ধারালো ঝিনুক আর শামুক। এটি হচ্ছে বালুকাময় তীর। এর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ জেট স্কিইং। কেননা এখানে যুক্ত হয় বঙ্গোপসাগরে ছুটে বেড়ানোর দুঃসাহস আর রোমাঞ্চের উত্তেজনা। পরের গন্তব্য ছুটে চলা মিনি বান্দরবানে। সাগরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নেওয়ার পর সবুজ শ্যামল পাহাড়ের একছটা রূপ হলো মিনি বান্দরবান। এর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগের পর আবার চললাম শেষ ঠিকানা হিমছড়ি উদ্দেশ্য। এটি কক্সবাজারে সেরা সৈকতের মধ্যে একটি। এখানে জলপ্রপাত রয়েছে যা প্রধান আকর্ষণ। এভাবে একে সকল পর্যটন স্থান ঘুরা শেষ হলো।
কেউ বাসের জানালার ফাঁকে আনমনা চোখে তাকিয়ে স্মৃতিচারণ, পরবর্তী ভ্রমণের পরিকল্পনা, কেউবা ক্লান্ত চোখে ঘুমে একটু বিশ্রামের আসায় এভাবেই ২দিনের রোমাঞ্চকর ভ্রমণ শেষে সাংবাদিকতা বিভাগের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্তব্যে আবারো যাত্রা করল। সময়, অবস্থান পরিবর্তন হয়ে যায়; কিন্তু জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি রয়ে যায় মনের ফোটবন্দিতে।
লেখক : শিক্ষার্থী, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া