১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। প্রেমিক-প্রেমিকারা এ দিনটিকে ঘিরে করে তোলে বিশেষ আয়োজন। লাল গোলাপে মোড়ানো হাত, চকোলেটের মিষ্টতা, উপহারের রঙিন মোড়ক, আর চোখে স্বপ্নজাল বুনে একে অপরকে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এই ভালোবাসার মোহরেখায় কখনো কখনো ঢুকে পড়ে নীলচিন্তা—নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার ভয়, দায়িত্বহীন আবেগের উচ্ছ্বাস, এবং সমাজ ও আত্মার প্রতি এক অদৃশ্য বিশ্বাসঘাতকতা। ভালোবাসা কি সত্যিই এভাবে উদযাপিত হওয়া উচিত?
ভালোবাসা কেবল এক দিনের উৎসব নয়, এটি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে অনুভবের বিষয়। ভালোবাসা মানে বিশ্বাস, দায়িত্ব, আত্মিক বন্ধন এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। প্রকৃত ভালোবাসা কখনোই কেবলমাত্র শারীরিক আকর্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আত্মার সংযোগ, যেখানে ভালোবাসার গভীরতা শুধু বাহ্যিক আলিঙ্গনেই নয়, বরং একে অপরের মনের অনুভূতি বোঝায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আধুনিক সমাজে ভালোবাসার সংজ্ঞা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ ভালোবাসাকে শুধুমাত্র শারীরিক ঘনিষ্ঠতার মাধ্যম হিসেবে দেখছে। প্রেমের নামে তারা নিজেদের শুদ্ধতা বিসর্জন দিচ্ছে, সম্পর্কের গভীরতাকে অগ্রাহ্য করে ক্ষণস্থায়ী মোহকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করছে।
১৪ই ফেব্রুয়ারি এলে শহরজুড়ে ভালোবাসার এক উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। রেস্টুরেন্ট, পার্ক, শপিং মলসহ প্রায় সব জায়গায় প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভিড়। হাতে লাল গোলাপ, কাঁধে ঝুলানো উপহারের ব্যাগ, চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। কিন্তু এই লাল রঙের মাঝেও লুকিয়ে থাকে নীলচিন্তা; যা ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা, এক ভুল সিদ্ধান্তের পরিণাম, সমাজের চোখ রাঙানি, পরিবারের প্রতি অসম্মান।
অনেকেই ভালোবাসার নামে সম্পর্কের শুদ্ধতা হারিয়ে ফেলে। আবেগের বশে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, অথচ সম্পর্কের প্রতি দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতির বিষয়ে থাকে উদাসীন। পরিণামে অনেক তরুণী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, পারিবারিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, এবং মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়। অপরদিকে, ছেলেদের মধ্যেও তৈরি হয় এক ধরণের অস্থিরতা, দায়বদ্ধতা থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা। এই পরিস্থিতি ভালোবাসার বিশুদ্ধতাকে কলুষিত করছে, যা আমাদের সমাজের জন্যও এক অশনিসংকেত।

ভালোবাসা পবিত্র, কিন্তু বর্তমান সময়ে কিছু বিষয় একে নোংরাভাবে উপস্থাপন করছে। এর বহুমুখী কারণও রয়েছে। পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষার অভাব এবং দায়িত্বশীল সম্পর্ক গড়ার উপদেশ না পাওয়ার ফলে অনেক তরুণ-তরুণী আবেগের বশে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি সিনেমা, ওয়েব সিরিজ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার এক ধরণের ‘গ্ল্যামারাইজড রোমান্স’ তরুণদের এমন একটি ধারণা দিচ্ছে যে, ভালোবাসা মানেই শারীরিক সম্পর্ক, না হলে তা অসম্পূর্ণ। বর্তমান প্রজন্ম ‘ইন্সট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন’ বা তাৎক্ষণিক আনন্দে অভ্যস্ত। তারা ধৈর্য ধরে সম্পর্ক গড়ে তোলার বদলে আবেগের তাড়নায় তৎক্ষণাৎ ঘনিষ্ঠতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ভালোবাসার পবিত্রতা এবং সম্পর্কের নৈতিকতা সম্পর্কে শিক্ষার এই অভাব এক ধরণের অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতার জন্ম দেয়, যা তরুণদের ভুল পথে ঠেলে দেয়।
ভালোবাসা দিবস উদযাপন করতে হবে, তবে তা যেন হয় সুস্থ, পরিশুদ্ধ, এবং নৈতিকতার মধ্যে। ভালোবাসা মানে কেবলমাত্র এক দিনের উপহার নয়, বরং সারাজীবন একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা। প্রেম মানে শুধু আকর্ষণ নয়, বরং একে অপরকে সম্মান করা, পরস্পরের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া, এবং ভবিষ্যতের জন্য একসঙ্গে পথচলা। যারা সত্যিকারের ভালোবাসে, তারা একে অপরের শারীরিক চাওয়া-পাওয়ার চেয়ে মানসিক বন্ধনকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা এবং সদস্য, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি ফিচার, কলাম এন্ড কনটেন্ট রাইটার্স।