একটি জাতির আত্মপরিচয় ফুটে ওঠে তার ভাষার মাধ্যমে। একটি দেশের ইতিহাস, শিল্প-সংস্কৃতি ও নানা সমৃদ্ধির কথা যখন অন্য দেশের মানুষ জানতে পারে তখন সেটা সে দেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের ও আনন্দের। আমরা বাঙালি জাতি, আমাদের ভাষা বাংলা। আমাদের এ দেশ যেমন শিল্প-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ, তেমনি এদেশের ঐতিহাসিক পরিচিতিও ব্যাপক। এ পরিচিতি তখনই সার্থক হয়ে উঠবে, যখন পুরো পৃথিবীর মানুষ আমাদের দেশকে এক নামে চিনবে এবং আমাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ গড়ে উঠবে। আর আমাদের দেশের এ পরিচয় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাবে আমাদের ভাষার মাধ্যমে। কিন্তু উন্নত ভাষা না হলে সে ভাষা খুব বেশি সমাদৃত হয় না, বরং ভাষার প্রতি অবহেলা বাড়লে সে ভাষা কালক্রমে বিলুপ্তির পথে চলে যায়।
আমাদের বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থাও খুব বেশি ভালো নয়। আমরা নিজেরাই আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাকে প্রতিনিয়ত বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছি। ১৯৫২ সালে যে ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এত বিরাট ত্যাগের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, প্রাণ গেছে এদেশের অনেক তরুণের, সে ভাষার প্রতি বর্তমানে এদেশের মানুষেরই দিন দিন অবহেলা বাড়ছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এদেশের আর্থসামাজিক পরিচয় বজায় রাখতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়েছিল এবং স্বাধীনতার পর দেশের মূল অঙ্গীকার ছিল জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ ঘটানো। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর পরেও আমরা সেই অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারিনি।

আসলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রয়োগে বাঙালিদের মধ্যে সচেতনতা ও চেষ্টার অভাব রয়েছে। অনেকে শিক্ষিত বাঙালি ব্যক্তিরাও শুধু হীনম্মন্যতার কারণে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন না। তা না হলে ভাষা আদান-প্রদানকারী বহিরঙ্গে বাঙালি হলেও বিবাহ, জন্মদিন, বউভাত ও গায়েহলুদসহ নানা দেশীয় সংস্কৃতির অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র ইংরেজিতে লেখেন কেন? পাকিস্তান আমলে রোমান হরফে বাংলা লেখায় আমরা আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু এখন সেই রোমান হরফেই কেন আমরা ইলেকট্রনিক ডিভাইসে বাংলা লিখছি? স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের সময় প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেন না। স্নাতক পর্যায়ে বাংলা বিভাগ ছাড়া প্রায় সব বিভাগেই অধিকাংশ কোর্স পড়ানো হয় ইংরেজিতে এবং বেশির ভাগ বিভাগে বাংলা ভাষা চর্চাবিষয়ক আলাদা কোনো কোর্স করানো হয় না। শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রতি এমন অবহেলা সত্যিই আশঙ্কাজনক।
দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রচারমাধ্যমের উপস্থাপক কথোপকথনের সময় বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণে এক অদ্ভুত বাক্য বিনিময় করে থাকেন। আমাদের নতুন প্রজন্ম স্মার্টনেস প্রকাশের প্রত্যয় থেকে বাংলার সঙ্গে বিভিন্ন ভাষার শব্দের সংমিশ্রণে এক অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করে। যেমন—ট্রিট, পিনিক, বিন্দাস, প্যারা, ভাল্লাগছে, আজিব ইত্যাদি। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অহরহ বাংলা ভাষার বিকৃত প্রয়োগ হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি স্মরণীয়, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি ভাষার পত্তন।’ তাই আমাদের বাংলা ভাষার সঠিক গঠন ও বিকাশ আগে রক্ষা করতে হবে।
বাংলা ভাষার দীনদশার মূল কারণ হলো আমাদের কোনো ভাষা নীতি নেই, নেই কোনো ভাষা পরিকল্পনা। ভাষা উন্নয়ন, গবেষণা, সাহিত্য চর্চা ও প্রচারের জন্য ১৯৫৫ সালে ‘বাংলা একাডেমি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রমিত উচ্চারণ প্রচলনে এই প্রতিষ্ঠানটিও যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারেনি। বাংলা ভাষাকে উন্নত করতে হলে সরকারকে আগে একটি সুপরিকল্পিত ভাষা কমিশন গঠন করতে হবে। যে কমিশন বাংলা ভাষার অগ্রগতি ও উন্নতিতে অন্তরায় দূরীকরণে কাজ করবে। পাঠযোগ্য ও বোধগম্য নয় এমন ভাষায় লেখা লেভেল ও সিল সংবলিত কোনো পণ্য বাজারজাতে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা না হলে বা সাইনবোর্ডে ইংরেজি অক্ষরের তুলনায় বাংলা অক্ষর যথেষ্ট বড় না হলে জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে নানা স্লোগানে ভাষা নিয়ে আমরা কত গর্বের কথা বলি, কিন্তু আসলে আমরা অন্তরে ভাষার চেতনা লালন করি বলে মনে হয় না। চীন, জাপান, কোরিয়া, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি উন্নত রাষ্ট্রগুলো মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করে নিজেদের এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। তাই উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের মাতৃভাষার দ্বারস্থ হতেই হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়