আমি একজন ভূতপূর্ব দুর্নীতিবাজ। চাকুরিজীবনে নানা কায়দা-কিসিমে ঘুষের টাকা ও সম্পত্তি হাসিল করিয়া এখন অবসর জীবনে বেশ দিনাতিপাত করিতেছি। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা-পয়সা কিছু কোম্পানি ব্যবসায়, কিছু সঞ্চয়পত্রে, কিছু শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট করিয়াছি। কয়েকটা বাড়ি করিয়া ভাড়া পাইতেছি বা খাইতেছি। এই টাকায় ‘সুন্দরভাবে’ দিন কাটিয়া যাইতেছে। খাওয়া-দাওয়া, বিদেশ ভ্রমণ, স্ফূর্তি সবই চলিতেছে। উহা হইতে সামান্য কিছু দানখয়রাত, জাকাত প্রদানে ব্যবহার করি। শুনিয়া খুশি হইবেন যে, দান-ধ্যান করিবার পাশাপাশি ইদানীং ধর্মের কাজেও অংশ লইতেছি। আল্লাহকে জোরেশোরে ডাকিতে শুরু করিয়াছি…।
যেহেতু, আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত পুরাতন ঘুষখোর, তাই ইদানীংকালে ঘুষের যে রকমফের হইয়াছে, উহা দেখিয়া আফসোসের শেষ নাই । পত্রপত্রিকায় ঘুষ-দুর্নীতির যেসব কেচ্ছাকাহিনি প্রকাশ পাইতেছে, তাহাতে মাঝে মাঝে মনে হয় অত আগে না জন্মিয়া একটু দেরিতে জন্মলাভ করিলে বোধহয় ভালো হইত! যেই দিকে তাকাইতেছি, সেই দিকেই কোটি কোটি টাকার কারবার। বড় ভলিউম মিস করিয়াছি!

দুর্নীতির চমকপ্রদ যেসব খবর প্রকাশ পাইতেছে, তাহাতে সাধারণ পাঠকরা সেসব খবর পড়িবার জন্য বেশ পুলক বোধ করিতেছেন। ইসলামী ব্যাংক হইতে নামে- বেনামে ৭০ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা লইয়া গিয়াছে একটি মাত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ। উহার মধ্যে সরাসরি নিজের নামে ৫৩ হাজার ২৭৭ কোটি এবং বেনামে লইয়া গিয়াছে ১৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা! আবার এক দিন পরের পত্রিকায় শেখ হাসিনা পরিবার ১০টি বড় বড় গ্রুপকে নানা ধরনের সুযোগ দেওয়ায় গ্রুপগুলির হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত্ করিয়া তাহা বিদেশে পাচার করার বিষয়ে তদন্ত শুরুর তথ্যও প্রকাশ করিয়াছে।
হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনা যখন দেশবাসীকে বিস্মিত করিয়া তুলিতেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে রাষ্ট্রকাঠামোর খোল-নলচে পালটে দেওয়ার মতো প্রস্তাব লইয়া চারটি সংস্কার কমিশনের প্রধান তাহাদের সুপারিশ সংবলিত সংস্কার প্রস্তাবগুলি গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নিকট হস্তান্তর করিয়াছেন। ‘দুদক সংস্কার কমিশনের’ দাখিলকৃত প্রতিবেদন উহাদের অন্যতম। ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন কমিশন ৩ অক্টোবর কার্যক্রম শুরু করে।
দুদক সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতিসহ ৪৭টি সুপারিশ পেশ করিয়াছে। সুপারিশগুলির মধ্যে অন্যতম হইতেছে :দুদককে শক্তিশালী, কার্যকর ও ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়িয়া তুলিতে কমিশনারদের পদ বাড়ানো, নিয়োগ, সার্চ কমিটি, আইনের সংস্কার, বেতন বৃদ্ধি ও প্রণোদনা। প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে ‘দুর্নীতি দমন’ শুধু দুদকের একার কাজ নহে । এখানে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রহিয়াছে। অর্থ পাচার বন্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু আইন করার কথা বলিয়াছে সংস্কার কমিশন।
কিছুদিন আগেই হংকংয়ে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে (মাত্র ০.০৮) নামিয়া আসিয়াছে। সে দেশের ‘দি ইনডিপেনডেন্ট কমিশন এগেইনস্ট করাপশন’ (আইসিএসি) নামীয় দুর্নীতি দমন সংস্থা মনে করে দুর্নীতি দমনে ভালো আইন ও ভালো সংস্থা যেমন দরকার, তেমনি ভালো লোকও দরকার। সে কারণেই সরকারের বিভিন্ন দপ্তর হইতে ভালো ও সত্ মানুষদের বদলি করিয়া আনা হয়। তাহারা নিরলস কাজ করিয়া হংকং হইতে দুর্নীতি মোটামুটি বিতাড়িত করিয়াছে। তাহাদের দপ্তরে কখনোই পেন্ডিং কেস থাকে না। সংস্থার অধীনে আলাদা পেশাদার গ্রুপ আছে, যাহাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। আমাদের দেশেও ভালো আইন, সত্ মানুষ থাকিলেই শুধু চলিবে না, দুদকের নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী থাকা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে শক্তিশালী দুদক কাজ শুরু করিলে অনেক দুর্দান্ত দুর্নীতিবাজ উহা প্রতিরোধ করিতে চেষ্টা করিবে। অতএব, আগেভাগেই বিষয়টি বাস্তবায়ন করা দরকার।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত ‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ গত ২৯ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়াছে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানাইয়াছেন, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও আর্থিক কারচুপির যে তথ্য পাওয়া গিয়াছে, তাহা আতঙ্কিত হইবার মতো! ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়, গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হইয়াছে দেশ হইতে!
প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, বড় বড় আমলা, গডফাদার, রাঘববোয়াল, চাঁই, উপনেতা, পাতিনেতা ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর, ছাগলকাণ্ডে ধরা এনবিআরের কর্তা, সাবেক ভ্যাট কমিশনার, সাবেক প্রথম সচিব, সাবেক দ্বিতীয় সচিব, বান্ধবী, ড্রাইভার সবই চাঞ্চল্যকর কিচ্ছা।
অধম দুর্নীতিবাজ পাঠক সমাজের কাছে চুপি চুপি একটা কথা বলিতে চাহেন যে, চাকুরী জীবনে দুর্নীতি করিলেও এখন ঐ ব্যাপারে দুর্নীতিবাজ অনুতপ্ত। দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধে প্রবেশ করিলে দেশের যে বারোটা বাজিয়া যায়, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা যে বিপন্ন হয়; দেশ, জাতি ও সমাজের যে দুর্নীতি প্রধান শত্রু এখন তাহা অনুমান করিতে পারি। তাই ওয়াদা করিতেছি যে, অনিয়ম, অপরাধ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমি এখন হইতে একজন লড়াকু সৈনিক হিসাবে কাজ করিয়া যাইব বলিয়া অঙ্গীকার করিতেছি। সেই মোতাবেক দুর্নীতি লইয়া সোচ্চার থাকিব।
লেখক : সাংবাদিক ও সমাজকর্মী