অর্থ পাচার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক দিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। অর্থ পাচারের সঙ্গে দুর্নীতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে দুর্নীতি বেড়ে গেলে অর্থ পাচারের প্রবণতাও বৃদ্ধি পায়। কারণ যারা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন, তারা চাইলেও সেই অর্থ প্রশ্নাতীতভাবে দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার করতে পারেন না। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থার কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয়। সমস্যা এড়ানোর জন্যই তারা বিদেশে অর্থ পাচার করে থাকে। বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই, যেখান থেকে অর্থ পাচার হয় না। তবে উন্নত দেশগুলো থেকে যে অর্থ পাচার হয়, তার মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম। সর্বস্তরে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত থাকলে অর্থ পাচারের প্রবণতা হ্রাস পায়। অর্থ পাচার যে কোনো দেশের অর্থনীতির জন্য একটি সমস্যা, অত্যন্ত ক্ষতিকর। দেশের অর্থ পাচার হলে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেয়। এমনিতেই বিগত প্রায় তিন বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতিপ্রবণতা বিরাজ করছে। বর্তমানে যে মূল্যস্ফীতি আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তাকে অসহনীয় বলা যেতে পারে। মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে সাধারণ নির্দিষ্ট আয়ের দরিদ্র মানুষগুলো খুবই অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছে।

অর্থ পাচার আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত জটিল একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সমস্যাটি কতটা গভীর, তা জানার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। বর্ণিত সময়ে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অর্থ পাচার কাজে জড়িত ছিলেন দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলা। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে রাজনৈতিক নেতারা ঘুষ গ্রহণ করেছেন ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। আমলারা ঘুষ নিয়েছেন ৯৮ হাজার কোটি টাকা। শেয়ার বাজার থেকে একটি মহল ১ লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা। পাচারকৃত টাকায় দুবাইয়ে কেনা হয়েছে ৫৩২টি বাড়ি। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশিদের বাড়ি রয়েছে ৩ হাজার ৬০০টি। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, সমস্যা যতটা গভীর ভেবেছিলাম, তার চেয়েও গভীর। আমাদের দেশ থেকে অর্থ পাচার দীর্ঘদিনের সমস্যা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তার মাত্রা অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের সমস্যাটি নানাভাবে উঠে এসেছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়ার ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) কয়েক বছর আগে তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মুদ্রা পাচার একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। পণ্য আমদানিকালে ওভার ইনভয়েসিং এবং পণ্য রপ্তানিকালে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করা হচ্ছে।
একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মুদ্রা পাচার অত্যন্ত জটিল এবং ক্ষতিকর একটি সমস্যা। যে কোনো মূল্যেই হোক, আমাদের অর্থ পাচার বন্ধ এবং ইতিমধ্যে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছে বলে বিভিন্নভাবে জানা যাচ্ছে। তবে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে, তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কোনো দেশের সরকারের কাছে পাচারও হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য সহায়তা কামনা করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো দেশের সরকারের কাছে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানালেই হবে না। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়টি বিচারিক প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করছে। যে দেশে অর্থ পাচার হয়ে গেছে, সেই দেশের বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে প্রচলিত আইনি কাঠামো অনুসরণ করেই কেবল পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। আমরা জানি, একসময় শ্রীলঙ্কা থেকে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট মার্কোসের সময় ফিলিপাইন থেকে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছিল। পরবর্তী সরকার নানাভাবে এসই পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু পাচারকৃত অর্থের খুব সামান্য অংশই তারা ফেরত আনতে সমর্থ হয়েছিল। তার মানে হচ্ছে, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ চাইলেই ফেরত আনা সম্ভব হয় না। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। অনেকেই মনে করেন, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করা হলে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা সম্ভব কিন্তু আমার তা মনে হয় না। কারণ অর্থ ফেরত আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের প্রচলিত আইন অনুসরণ করেই এগোতে হবে। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে, যারা পাচারকৃত অর্থ তাদের দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য উত্সাহিত করে; যেমন—মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে কোনো বিদেশি নাগরিক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলে তাকে দেশটির নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তুরস্কও সম্প্রতি মালয়েশিয়ার আদলে সেকেন্ড হোম প্রকল্প চালু করেছে। সেখানে ২০০ বাংলাদেশি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছে বলে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। কাজেই চাইলেই পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা যাবে না। এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলাদা করে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
যে কোনো মূল্যেই হোক, অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। আর এটা করতে হলে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে, অর্থ পাচরের মাধ্যমটি কী? বা কীভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে? কোনো দেশ থেকে নানাভাবেই অর্থ পাচার হতে পারে। সরাসরি নগদে অর্থ পাচার হতে পারে। তবে কোনো দেশ নগদ অর্থ পাচার করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বর্তমানে নগদে অর্থ পাচার হয় খুবই কম। অর্থ পাচারের সবচেয়ে সহজ পন্থা বা উপায় হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচার করা। আমদানিকারকগণ কোনো পণ্য আমদানিকালে তার মূল্য বেশি দেখিয়ে বা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ বিদেশে পাচার করতে পারেন। আবার রপ্তানিকারকগণ আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে রপ্তানি পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে বিদেশে অর্থ রেখে দিতে পারেন। আন্তর্জাতিক কোনো কোনো সংস্থা বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তার ৬৫ শতাংশের মতো যায় আমদানি-রপ্তানির আড়ালে। বর্তমানে তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে একটি পণ্যের মূল্য কত, তা জানা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে একটি পণ্য কত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে আর যারা আমদানিকারক তারা সেই পণ্যটির কত মূল্য প্রদর্শন করছে এই দুয়ের মধ্যে যে পার্থক্য, তা যাচাই করলেই বোঝা যেতে পারে, পণ্যটির মূল্য বেশি দেখানো হচ্ছে কি না। পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। কোনো পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে কত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে আর স্থানীয় রপ্তানিকারকগণ সেই পণ্যটির মূল্য কত প্রদর্শন করছে এটা যাচাই করলেই পাচারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে।
যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে মুদ্রা পাচার অত্যন্ত জটিলতার সৃষ্টি করে। দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিকভাবে পরিচালনার জন্য মুদ্রা পাচার কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে দেশ থেকে অর্থ পাচারের যে তথ্য আমাদের কাছে আছে, তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে অর্থ পাচারের সমস্যা থেকে মুুক্তি পাওয়ার জন্য অর্থ পাচারোত্তর তা ফিরিয়ে আনার চেষ্টার পাশাপাশি দেশ থেকে যাতে অর্থ পাচার হতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকলে মুদ্রা পাচার কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না। তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দুর্নীতি বন্ধ করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। যদি অবৈধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ বন্ধ করা যায়, তাহলে অর্থ পাচারও কমে আসবে। আমাদের সেই প্রচেষ্টাই করতে হবে।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা
অনুলিখন : এম এ খালেক