গেল সপ্তাহটি ছিল মার্কিন-ইউরোপীয় সম্পর্কের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া তিনদিনব্যাপী এ সম্মেলন ঘিরে স্বভাবতই ব্যস্ত সময় পার করেছে পক্ষগুলো। পেন্টাগনের প্রধান পিট হেগসেথ প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক সফরে উড়ে যান ইউরোপের মাটিতে; অংশ নেন ব্রাসেলসে ন্যাটোর এক বৈঠকে। এটা ছিল মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সেরও প্রথম আনুষ্ঠানিক ইউরোপ সফর। ফলে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে তাকেও; প্যারিসে বক্তৃতা করেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে।
একদিকে যখন এসব চলছে, অন্যদিকে তখন আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে মার্কিন নাগরিকেদের মধ্যে! মার্কিনরা চমকে উঠেছেন একটি চমকপ্রদ খবরে! দীর্ঘদিন যাবৎ রাশিয়ায় বন্দী থাকা এক আমেরিকানকে বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার কয়েদখানা থেকে কোনো মার্কিন নাগরিকের মুক্তি লাভের ঘটনা আমেরিকানদের তো বটেই, সারা বিশ্বের জন্যই সুখের সংবাদ!

মিউনিখ সম্মেলনকে সামনে রেখে দীর্ঘ ফোনালাপ হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে। এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য ছিল, ইউক্রেন সংকট নিরসনের লক্ষ্যে একটি কার্যকর শান্তি আলোচনা শুরু করা নতুন করে।
তিন বিশ্বনেতার ঐ আলোচনার পরপরই শুরু হয় বার্ষিক মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের এবারকার আসর। বলা বাহুল্য, ইউরোপীয়, আমেরিকান এবং সর্বোপরি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উড়ে আসা প্রতিনিধিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন ভ্যান্সের বক্তব্য শোনার জন্য। এর কারণ, তার বক্তব্যের মধ্য দিয়েই মূলত বোঝা যাবে ইউরোপের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক, ন্যাটোর ভবিষ্যৎ এবং রাশিয়া-আমেরিকা সম্পর্কের ভবিষ্যতের রূপরেখা।
সব মিলিয়ে ব্যস্ত সপ্তাহটি ছিল নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের জন্যও একটি টার্নিং পয়েন্ট। কারণ, ক্ষমতার নতুন মেয়াদে তিনি কী ধরনের কর্মপন্থা ঠিক করবেন, কী ধরনের দিকনির্দেশনা তৈরি করবেন, সেসবের একটি ¯পষ্ট রেখাচিত্র পাওয়া যাবে এই সম্মেলন থেকে।
এই লেখা পর্যন্ত মিউনিখ সম্মেলন চলছে। ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের ভবিষ্যত রূপরেখা সম্পর্কে এখনই বেশি কিছু জানার সুযোগ নেই। যদিও বিশ্লেষকরা এরই মধ্যে মন্তব্য করেছেন যে, ট্রাম্প সম্ভবত ইউরোপ নিয়ে ভাবছেন। এই ভূখণ্ডের নিরাপত্তার বিষয়কেই তিনি অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিয়ে এ-ও বলেছেন যে, ‘… সেক্ষেত্রে ট্রাম্পের উচিত হবে, তার প্রথম মেয়াদের দিকে ফিরে তাকানো এবং তা থেকে শিক্ষা নেওয়া।’
প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘ইউরোপ নীতি’ কেমন ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর ইউরোপীয়দেরও অজানা নয়। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদকে তারা নিশ্চয়ই মনে রেখেছে! মিউনিখে ভ্যান্সের বক্তৃতায়ও সেই স্মৃতিই প্রতিধ্বনিত হতে দেখা গেল। ইউরোপীয় মিত্রদের সামরিক খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করা, তথা ন্যাটো তহবিল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতি-নির্ভরতার কড়া সমালোচনা করেছেন তিনি। সত্যি বলতে, তার দাবি অযৌক্তি নয়, যেটা ট্রাম্পও প্রায়ই বলে থাকেন।
মজার ব্যাপার হলো, ট্রাম্প মুখে যাই বলুন না কেন, ইউরোপকে তিনি খাঁটো করে দেখেন, এমন কথা কেউ বলতে পারে না। তার বা তার প্রশাসনের মুখের কথা এবং বাস্তব নীতির দিকে দৃষ্টি দিলেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম মেয়াদে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা খাতে ট্রাম্প প্রশাসন ওবামা প্রশাসনের তুলনায় ৪০ শতাংশেরও বেশি বিনিয়োগ করেছিল। অর্থাৎ, ইউরোপের ‘সামরিক খাতে ব্যয় না করতে চাওয়া’ নিয়ে ট্রাম্প তীব্র সমালোচনা করলেও ইউরোপ প্রশ্নে তার প্রশাসন যথেষ্ট মনযোগী বলেই মনে হয়।
২০২১ সালে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজ ছাড়ার সময় ইউরোপে মার্কিন সেনা উপস্থিতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। ব্যাপকভাবে বিস্তৃৃত হয়েছিল প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও। এমনকি ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার করতেও নানা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন তিনি। মার্কিন তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) রপ্তানি বৃদ্ধি করার মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর থেকে ইউরোপীয়দের নির্ভরতা কমিয়ে আনতে গ্রহীত তার উদ্যোগগুলো সেসময় প্রশংসিত হয় বেশ। যেমন, ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তাকে দুর্বল করে দেওয়া নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইনের ওপর তিনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, যা ছিল ট্রাম্পের সাহসী পদক্ষেপ।
ট্রাম্পই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি ইউক্রেনকে উন্নত অ্যান্টি-ট্যাংক অস্ত্র সরবরাহ করেন। যেখানে ওবামা প্রশাসন বারবার ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে প্রথম মেয়াদেই তা করে দেখিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পাশাপাশি তিনি রুশ গুপ্তচর ও কূটনীতিকদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে গণহারে বহিষ্কার করেছিলেন, যা ইতিহাসে বিরল। শুধু তাই নয়, তিনি সিয়াটল ও সান ফ্রান্সিসকোতে রাশিয়ান কনস্যুলেট এবং ওয়াশিংটন ও নিউ ইয়র্কে রাশিয়ার দুই দুটি বাণিজ্যিক অফিস বন্ধ করার সাহস দেখিয়েছেন নিজের প্রথম মেয়াদেই।
অর্থাৎ, প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প প্রশাসন যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তা দেখে কোনোভাবেই মনে হয় না যে, ইউরোপকে তিনি উপেক্ষা করেন। সত্যিই, এ ধরনের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাবে না; বরং বলতে হয়, ইউরোপের নিরাপত্তা এবং ট্রান্সআটলান্টিক নেতৃত্বের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী প্রতিশ্রুতির বিষয়েই তিনি বার বার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন! এ ধরনের কৌশলগত চিন্তাভাবনা ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রশাসনকেও পথ দেখিয়ে সামনে নিয়ে যাবে।
এরকম একটি প্রেক্ষাপটে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, ইউরোপ কি এখনো মার্কিন স্বার্থের জন্য অপরিহার্য? বস্তুত, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের পর চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। এ কারণে অনেকে বলে থাকেন, বর্তমানে ওয়াশিংটনের জাতীয় নিরাপত্তার মূল কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত পূর্ব এশিয়া। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর মতো ব্যক্তিরা মনে করেন, বর্তমান বহুমেরুকরণ ব্যবস্থায় বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেবল কোনো একক অঞ্চলের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করলেই চলবে না। মার্কোর কথায় যুক্তি আছে বটে।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মার্কিন অর্থনীতির জন্য ইউরোপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সম্মিলিত জিডিপি বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় অর্ধেক জিডিপির সমান। যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত যেসব বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তার দুই-তৃতীয়াংশই আসে ইউরোপ থেকে। তদুপরি, আমেরিকার সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার হচ্ছে ইউরোপ। ৫০টি মার্কিন রাজ্যের মধ্যে ৪৮টি রাজ্য ইউরোপে চীনের তুলনায় বেশি পণ্য রপ্তানি করে থাকে। ট্রাম্প, যিনি নিজেও একজন ব্যবসায়ী, এই বা¯তবতা অজানা নয় তারও। ফলে তিনি বেশ ভালো করেই উপলব্ধি করেন যে, যখন একটি আমেরিকান পণ্য রপ্তানি হয়, তখন একজন মার্কিন নাগরিকের চাকরি আরও বেশি সুরক্ষিত হয়।
এ রকম একটা পটভূমিতে উঠে আসে রাশিয়া এবং পুতিনের কথাও! পুতিন ইউরোপের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি এবং ন্যাটোর সম্মিলিত শক্তিই মার্কিন বৃহত্তম রপ্তানি বাজার, তথা ইউরোপের নিরাপত্তার প্রধান রক্ষক। অর্থাৎ, ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার চিন্তা কেবল নির্বোধ সিদ্ধান্তই নয়, বরং তা হবে কৌশলগতভাবে বিপজ্জনক পদক্ষেপ।
মনে রাখা জরুরি, রাশিয়া এখনো আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনে। সেখানে রাশিয়াকে সহায়তা করছে উত্তর কোরিয়ার সেনা ও ইরানি ড্রোন। এর ফলে পূর্ব ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তা একে অপরের সাথে জটিলভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়ছে।
ঠিক এমন একটি অবস্থায়, ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে ইউরোপের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখাই হবে ওয়াশিংটনের বিচক্ষণতা। বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এই বার্তা দিচ্ছে যে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির জন্য ইউরোপ এখনো অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এমতাবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসনের উচিত, একটি কৌশলগত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যা ন্যাটোকে আরও শক্তিশালী করবে, ইউক্রেনকে সমর্থন দেবে এবং ইউরোপীয় নিরাপত্তায় মার্কিন নেতৃত্ব বজায় রাখবে।
সর্বোপরি, ট্রাম্প প্রশাসনের ইউরোপ নীতি শুধুমাত্র প্রচার-প্রচারণা বা বক্তৃতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবে না। বরং যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এ বিষয়ে খোলাসা করে কথা বলতে হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় উপস্থিতি কেবল ইউরোপের জন্যই নয়, বরং এটি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : হাডসন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : সুমৃৎ খান সুজন