ভারতের রাজধানী দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে দশ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টি গেরুয়া শিবিরের কাছে পরাজয় বরণ করেছে। দিল্লিতে কেন আম আদমি পার্টির পরাজয় হলো? কেন্দ্রে শাসক দল বিজেপি বলতে গেলে ওত পেতে ছিল দেশের গুরুত্বপূর্ন এই নগর রাজ্যটির দখল নেয়ার জন্য। ১৯৫২ সাল থেকে জাতীয় রাজধানী দিল্লি অঞ্চলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের চৌধুরী ব্রহ্ম প্রকাশ থেকে শুরু করে ৭ জন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরের জন্য এখানকার মুখ্যমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করা হয়েছিল। আবার দিল্লি বিধান সভা চালু হলে ভারতীয় জনতা পার্টি ১৯৯৩ সালের প্রথম নির্বাচনে জয় লাভ করে। দিল্লি বিধান সভার আসন সংখ্যা ৭০। ভোটে জিতে ৫ বছরের মেয়াদে দলের তিন জন নেতা এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরের ১৫ বছর কংগ্রেসের হাতে ছিল শাসন ক্ষমতা। ২০১৩ সালে নতুন দল গঠন করে অরবিন্দ কেজরীওয়াল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। তার বিজয় ছিল সেই সময়ে চমকে দেয়ার মতো ঘটনা। প্রায় ২৭ বছর পর বিধানসভা ভোটে জিতে দিল্লির ক্ষমতা আবার দখল করলো বিজেপি।
এবার অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির (আপ) পুরানো নেতাদের দলত্যাগ বা তাদের অন্য দলে যোগদানের ঘটনা ঘটে। আপের এই হার দলের ‘অস্তিত্বের’ ওপর কি কোনো প্রভাব ফেলবে? ২০২০ সালের বিধানসভা ভোটে আটটা আসন জিতেছিল বিজেপি। আর সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ আরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল সে বছর জিতেছিল ৬২টা আসন। কিন্তু ৫ বছরে পাশার দান উল্টে গেল। দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মি. কেজরিওয়াল এবং সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদিয়া দু’জনেই সাম্প্রতিক ভোটে হেরেছেন। দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব সামলানো আতিশী অবশ্য নিজের আসনে জয়ী হয়েছেন।

দলের পরাজয়ের একটা কারণ হাজির করেছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আতিশী। তার মতে, এতো গুন্ডামির মধ্য দিয়ে এই নির্বাচন হয়েছে যে, দিল্লির ইতিহাসে এমন নির্বাচন কখনও হয়নি। প্রকাশ্যে টাকা ও মদ বিলি করা হয়েছে। পরাজয়ের পর তিনি এ কথা বলতেই পারেন। তাতে ফল পাল্টাবে না। এছাড়া আগের বিধানসভা নির্বাচনে দিল্লির বস্তি অঞ্চল থেকে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল আপ। কিন্তু এইবার সেই চিত্র পাল্টে গেছে। মধ্যবিত্তদের ভোটও ধরে রাখতে পারেনি দলটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, যে ‘স্বচ্ছ রাজনৈতিক ভাবমূর্তি’কে সামনে রেখে রাজনীতির ময়দানে নেমেছিল আম আদমি পার্টি, সেখান থেকে তারা অনেকটাই সরে গিয়েছিল, অন্তত মানুষের কাছে সেটাই মনে হয়েছে।
দিল্লির দূষণ কমানো, রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন, যমুনার পানি পরিশোধনের মতো একাধিক বিষয়েও তারা নজর দেননি। এর প্রভাব ভোটে পড়েছে। আর দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রীসহ আপের শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ দলের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করেছে। আম আদমি পার্টির সরকারের বিরুদ্ধে দিল্লির আবগারি নীতিতে বদল এনে কিছু লোককে ‘অনৈতিক’ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও ওঠে।
লাইসেন্স ফি কমানো এবং উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই লাইসেন্সের মেয়াদ বাড়ানোর অভিযোগও ওঠে। মি. কেজরিওয়ালকে এসব অভিযোগে গ্রেফতারও করা হয়। তৃতীয়ত, দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় মানুষদের চিকিৎসার জন্য তৈরি মহল্লা ক্লিনিককে কেন্দ্র করেও আম আদমি পার্টির বিরুদ্ধে একাধিক প্রশ্ন উঠেছে। চতুর্থত, কেজরিওয়ালের বিলাসবহুল বাসভবনকে ঘিরেও বিরোধীরা নানা আক্রমণ করেছে। তাতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেজরিওয়ালের ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে যা কাজ করেছে তা হলো তার বাসভবন সংস্কার। কারণ সাধারণ মানুষ ভাবতে থাকেন যে, তিনি বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
নির্বাচনে কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়েও বিশ্লেষকরা মত দিয়েছেন। অনেকে মনে করেন, বিজেপি রোধে কংগ্রেসের হাত যদি আপের ঝাড়ু ধরতো তা হলে বিপর্যয় ঠেকানো যেত। ভোটের এই সমীকরণে ইন্ডিয়া জোটের শরিক কংগ্রেস কিছুটা হলেও আপের হয়ে ‘ব্যাটিং’ করতে পারত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, ভোটের ফলাফল থেকে এটা স্পষ্ট যে কংগ্রেস এবং আপ একসঙ্গে লড়লে বিজেপিকে বেগ পেতে হতো। বরং কংগ্রেস আপের বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছে। এখানে কংগ্রেস বিজেপির বি টিমের ভূমিকা পালন করেছে বলেও মনে করেন তারা। তারা বলেন, দলদুটো একে অপরের বিরুদ্ধে এই ভোটে লড়েছে। আপ জিততে পারত যদি কংগ্রেস তাদের সঙ্গে লড়ত। আসাদুদ্দিন ওয়াইসির দলের মতো একাধিক দলের পৃথক উপস্থিতির ফলে আপের ভোট কমেছে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এই দলগুলোর ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ায় বিজেপির সুবিধা হয়েছে। বিজেপি ভোট পেয়েছে প্রায় ৪৫.৮% জিতেছে ৪৮ আসনে। আম আদমি পার্টি পেয়েছে ৪৩.৫০%, জয় ২২ টি আসনে। দু দলের তফাৎ মাত্র ২.৩০% ভোট। কংগ্রেস ভোট পেয়েছে ৬.৩৬%। কোন আসন পায়নি। কংগ্রেস আপকে সমর্থন দিলে বিজেপি বিরোধী শক্তির ভোট হত ৫০%; যা বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার জন্য যথেষ্ট হতো।
আম আদমির পরাজয় হলেও ভোটের হিসাব বলছে ব্যবধান খুবই কম, মাত্র ২.৩ শতাংশ। ফলে কেজরিওয়াল আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। আগামী পাঁচ বছর আপ একটি শক্তিশালী ও গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারে। দলের ভুলগুলো খতিয়ে দেখাই এখন তার প্রধান কাজ হওয়া উচিৎ।
লেখক : সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক