ভাষা শহীদ হিসেবে যে পাঁচজন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রথম ভাষা শহীদ মানিকগঞ্জের সিংগাইরের বলধারা ইউনিয়নের পারিল (রফিক নগর) গ্রামের রফিক উদ্দিন আহমদ। আর তাঁর স্মৃতিতে ১৫ বছর আগে ণির্মিত সিংগাইরের রফিকনগরে তাঁর নামানুসারে গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি সারা বছর এক প্রকার ফাঁকা পড়ে থাকলেও ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা হলেও বাড়ে প্রাণচাঞ্চল্য ও দর্শনার্থীদের উপস্থিতি। সবাই যেন ছুটে আসেন শহীদ রফিককে এক নজর দেখতে!
স্মৃতি হিসেবে এই গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে সুসজ্জিত আলমারিগুলোতে সাজানো বই ও ভাষা শহীদের ব্যবহৃত পোশাক এবং আসবাবগুলোই কেবলমাত্র জানান দিয়ে যাচ্ছে সেদিনের বায়ান্নর উত্তাল দিনগুলোর কথা। এছাড়া ভবনের সামনের দিকে দেয়ালে শহীদ রফিকের একটি ম্যুরাল ও ভেতরে দুটি ছবিই জাদুঘরের নিদর্শন বহন করে চলেছে যুগের পর যুগ।

আবদুল লতিফ ও রাফিজা খাতুন দম্পতির ঘরে ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর উপজেলার পারিল (রফিক নগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রফিক ছিলেন বড় সন্তান।
১৯৪৯ সালে রফিক স্থানীয় বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। তবে পড়ালেখা শেষ না করে তিনি ঢাকায় গিয়ে পিতার মুদ্রণশিল্প ব্যবসায় যুক্ত হন। এরপর ঢাকায় তিনি পুনরায় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বরকত ও জব্বারের সঙ্গে নিহত হন রফিক।
এদিকে ২০০০ সালে রফিক উদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আবদুস সালাম ও শফিউর রহমানকে রাষ্ট্রীয় একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারী) গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি দেখতে আসা সিংগাইর সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জুবায়ের হোসেন বলেন, ‘মাঝেমধ্যে এখানে ঘুরতে আসি। এত দিন ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের কোনো স্মৃতিচিহ্ন ছিল না জাদুঘরে। ভাষাশহীদকে দেখতে পারি নাই, কিন্তু জাদুঘরে তাঁর ব্যবহার করা পোশাক ও চেয়ার-টেবিল দেখতে তো পারছি। এছাড়াও পড়তে পারছি ভাষার উপর লেখা বিভিন্ন লেখকের বই।’
ঘুরতে আসা স্থানীয় আরেক শিক্ষার্থী রুহুল আমিন বলেন, ‘মায়ের ভাষা রক্ষার আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী রফিক উদ্দিন আমাদের গর্ব । ভাষাশহীদ রফিকের জন্ম যে গ্রামে, সেই রফিকনগরে আমারও জন্ম। তাই আমরা নিজেরাও এতে গর্ববোধ করি।’
দিবসটি উপলক্ষে ভাষা শহীদ রফিকের বাড়ির পাশে ভাষাশহীদ রফিক মঞ্চে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহিদ রফিক স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে ৫ দিন ব্যাপি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহিদ দিবস উপলক্ষে একুশে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। মঞ্চের পাশে বসেছে গ্রামীণ মেলাও। শনিবার পর্যন্ত চলবে এসব অনুষ্ঠান ও মেলা। তবে অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সাধারণ মেলার পাশাপাশি আরো বড় পরিসরে বই মেলার আয়োজন থাকলেও ভালো হতো।
মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদ ও স্মৃতি জাদুঘর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ও জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে রফিক উদ্দিনের নিজ গ্রাম রফিকনগরে (পারিল) ৩২ শতক জমির ওপর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি গড়ে তোলা হয়। শহীদ রফিকের প্রতিবেশী কর্নেল (অব.) মজিবুল ইসলাম খান জমিটি দেন। একই বছরের ১৫ মে এটি উদ্বোধন করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

সরেজমিনে দেখা যায়, জাদুঘরে কয়েকটি আলমারিতে রয়েছে বিভিন্ন বই। জাদুঘর থেকে ২৫০ থেকে ৩০০ গজ দূরেই শহীদ রফিকের পৈতৃক ভিটা। সেখানে ২০০০ সালে প্রশিকা মানবিক উন্নয়নকেন্দ্র ওই বাড়িতে পাঠাগার ও বাসগৃহ নির্মাণ করে দেয়। সেখানে বসবাস করে শহীদ রফিকের ভাই মৃত আবদুল খালেকের পরিবার। বাড়িটির পাশে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ১৫ বছর পর ২০২৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ পরিবার রফিকের ব্যবহৃত লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, চারটি চেয়ার, একটি টেবিল ও একটি টেবিল ক্লথ জাদুঘরে দেয়। এর মধ্যে ২০০০ সালে পাওয়া রফিকের একুশে পদকের সম্মাননা স্মারকও রয়েছে।
গ্রন্থাগারের ও জাদুঘর দেখভালের দায়িত্বে থাকা ভাষা শহীদ রফিকের ভাতিজা মো. শাহজালাল বলেন, প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত এলাকাবাসী এবং দর্শনার্থীদের জন্য গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটি খোলা থাকে। এলাকার ছাত্রছাত্রীরা ভাষাশহীদের ব্যবহৃত পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, চেয়ার-টেবিল দেখতে আসে। দূর থেকে দর্শনার্থীরাও এখানে আসেন।
গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটিতে কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও জানালেন গ্রন্থাগারিক ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, গ্রন্থাগারে বাংলা একাডেমি থেকে দেওয়া প্রায় ১৬ হাজার বই রয়েছে। গ্রন্থাগারে চারটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা দেওয়া হতো। তবে পত্রিকার এজেন্ট মারা যাওয়ার পর প্রায় দুই বছর ধরে সেখানে কোনো পত্রিকা দেওয়া হয় না। তিনি আরো বলেন, গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটি দেখভালকারী শাহজালাল এবং তাঁর নিজের চাকরি এখনো স্থায়ী হয়নি। এ ছাড়া তাঁদের বেতনও অপ্রতুল।
ভাষা শহিদ রফিক স্মৃতি পরিষদের সভাপতি (ভাষা শহিদের অনুজ) বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. খোরশেদ আলম বলেন, অনুষ্ঠান চালানো ও শিশুশিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা আয়োাজন করতে বিপুল অর্থের প্রয়োাজন হয়। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে এসব অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে তাঁদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।