একটি রাষ্ট্রে আয় বণ্টনব্যবস্থায় সামগ্রিকভাবে সে দেশের নাগরিকদের মধ্যে আয়-রোজগারের যে তারতম্য, তার ফলে যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয় তা দূর করা বাঞ্ছনীয়। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৭১ ভাগ মানুষ সেসব রাষ্ট্রে বসবাস করে, যেখানে আয়বৈষম্য প্রকট। আয়বৈষম্য আন্তর্জাতিকভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সামাজিক সমস্যা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং কর্মে অদক্ষতা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায় এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়। আয়বৈষম্যের কারণে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং ডিজিটাল ক্ষেত্রেও সুযোগ পাওয়ার ন্যাযতা ও প্রাপ্যতা হ্রাস পায়।
বিশ্বের মোট আর্থিক সম্পদের ৪৩ ভাগ মোট জনসংখ্যার ১ ভাগের কাছে গচ্ছিত রয়েছে। এই যে বণ্টনব্যবস্থায় অসাম্য, এর ফলে মানুষের যে মৌলিক চাহিদাগুলো রয়েছে, সেগুলো পূরণ করা সম্ভব হয় না। স্বাস্থ্য খাতের কথা বিবেচনায় আনলে ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। গুণমানসম্পন্ন শিক্ষার ক্ষেত্রে অনুন্নয়নের দুষ্টচক্র কাজ করে, ঝরে পড়া বেড়ে যায় এবং কর্মমুখী শিক্ষার বদলে বরং বেকারত্বের বোঝা সৃষ্টি করে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকার দরুন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। সামাজিক যে বৈষম্য, তা বৃদ্ধি পায়, সামাজিক অস্থিরতার কারণে সামাজিক অনাচার বেড়ে যায় এবং মানবীয় পুঁজির সংকট দেখা দেয়।
কারিগরি বিবর্তনের ফলে ও লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে বিশ্বের যেসব দেশ উন্নতি লাভ করেছে, সেসব দেশের যে নাগরিকেরা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে গড়ে ওঠে, তারাই কেবল উন্নত জীবনে সহজে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। এজন্যই ডিজিটাইজেশান সেসব দেশের নাগরিকেরা সুবিধা অর্জন করতে পারে। যারা ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারে সক্ষম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইন্টারনেট অব থিংকিং বল্কচেইন, মেশিন লার্নিং সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দক্ষ মানব হিসেবে টিকে থাকার জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংকিং, বিমা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, উত্পাদন ব্যবস্থাসহ সর্বত্র প্রায়োগিক কৌশক গ্রহণ করতে হবে। যখন আয়বৈষম্য বাড়ে তখন যারা বৈষম্যের শিকার হয়, তারা কর্মদক্ষতা হারিয়ে ফেলে এবং হতোদ্যম হয়ে পড়ে। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র তাদেরকে গ্রাস করে।
বৈশ্বিক আয়বৈষম্যের কারণে ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যাও বৃদ্ধি পায়। যারা ধনবান শ্রেণি, তারা দরিদ্র শ্রেণিকে শোষণ ও বঞ্চনা করে। বর্তমানে কেবল উন্নয়নশীল দেশ নয়, উন্নত দেশগুলোতেও আয়বৈষম্য ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই আয়বৈষম্য শেষ পর্যন্ত সম্পদবৈষম্যকে প্রকট করে তুলেছে। সম্পদহীন মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে বোঝা হিসেবে পরিগণিত হয়। যারা দুর্নীতিবাজ, অসাধু, তারা অতি সহজেই বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীকে স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করে থাকে। রাষ্ট্র থেকে অবৈধ পন্থায় অর্থ-সম্পদ পাচার করে থাকে। হীনস্বার্থে এ পাচারকৃত অর্থ কালো অর্থনীতিতে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে মাদক থেকে শুরু করে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারসহ নানাবিধ ক্ষেত্রে আন্ডারগ্রাইন্ড (Underground) অর্থনীতিতে প্রয়োগ করে। এ ধরনের অপতত্পরতা সমাজ ও রাষ্ট্রকে একধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, আইনগতসহ পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি করে। লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার ফলে খাল-বিল-নদী-নালা-পাহাড়-জঙ্গলসহ গিলে খাওয়ার মতো দুর্বৃত্ত দল ধনিক শ্রেণির মধ্যে সৃষ্টি হয়।
বৈষম্য বৃদ্ধির দরুন মানুষের অবস্থা ত্রাহি মধুসূদনের সৃষ্টি করে। মুদ্রা বিনিময় হারেও একটি দেশের অভ্যন্তরীণ মুদ্রার মূল্যও হ্রাস পেয়ে থাকে।
গিনি সহগের সহায়তায় একটি রাষ্ট্রের আয়বৈষম্য নিরূপণ করা যায়। গিনি সহগ অবশ্য সম্পদের বৈষম্য, এমনকি লাইফ এক্সপেক্টন্সি মাপতেও ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS)-এর হিসাব অনুসারে ‘গৃহস্থালী আয় ও ব্যয় সমীক্ষা, ২০২২’-এ প্রকাশিত তথ্য অনুসারে ২০১০ সালে গিনি সহগ ছিল ০.৪৫৮, ২০১৬ সালে গিনি সহগ ছিল ০.৪৮২ এবং ২০২২ সালে গিনি সহগ আরো বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ০.৪৯৯। গিনি সহগের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির যে হিসাব প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এ দেশের আয়বৈষম্য ২০১০ থেকে ২০২২ সালে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত গিনি সহগের হিসাব অনুসারে দেশে দারিদ্র্য হ্রাস পাওয়ার কথা থাকলেও দারিদ্র্য না কমে বেড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
আয়বৈষম্য হ্রাস করতে হলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনাতে স্বচ্ছতা আনয়ন করা, মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিকে একই সঙ্গে সমান্তরালে প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করতে হবে; ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা দরকার, করব্যবস্থাপনাতেও প্রত্যক্ষ করকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার, অপ্রচলিত খাতে ও নতুন নতুন খাতে করারোপ করতে হবে, দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ অফিশিয়াল চ্যানেলে ফিরিয়ে আনা দরকার, সরকারি অর্থ ব্যয়ে কৃচ্ছ্র সাধন করা এবং মানবকল্যাণের জন্য ব্যয় করা, সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণ এবং চাঁদাবাজি যাতে না হয় ও সিন্ডিকেট করে কেউ যেন অর্থ লোপাট করতে না পারে, সেদিকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। সর্বোপরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষিত বেকার ও অশিক্ষিত বেকার দুটোই যে কোনো সমাজব্যবস্থার জন্য বোঝাস্বরূপ। শিক্ষাকে জীবনমুখী এবং চাকরির বাজারমুখী করতে হবে।
একচেটিয়া মুনাফা যাতে কেউ গ্রহণ করতে না পারে, সেদিকেও সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। স্বাস্থ্য খাতে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা উচিত।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ‘অসাম্য বিনিময়’ বন্ধ করে ন্যায্য বাণিজ্যের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। ধনবান শ্রেণির ওপর করের পরিমাণ বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। যেহেতু কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব, সেহেতু উদ্যোক্তা তৈরি করার ব্যবস্থা নিতে হবে—যা মূলত হাতে কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সম্ভব।
আয়বৈষম্য একটি সামাজিক ব্যাধি এবং এটি দূর করতে হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থার প্রয়োজন এবং আর্থিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে নাগরিকেরা যাতে সমান সুযোগ-সুবিধা পায়, সেদিকে খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়। মানবকল্যাণের জন্য সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সবচেয়ে বেশি দরকার। সাম্য, ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখা উচিত।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, উদ্যোক্তা বিশেষজ্ঞ, আইটি বিশেষজ্ঞ। সাবেক ভিসি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা