তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাত যেন ফুরায় না! সকাল এলেও দেখা যায়, সকালের জ্যোতি নেই। ঘড়ির কাঁটা সবাইকে ইঙ্গিত করলেও আকাশের ঈশানকোণ থেকে ঝোড়ো হাওয়া ফুরায় না। পুব আকাশ লাল হয়েও যেন সেই আভা সেখানেই স্তব্ধ হয়ে থাকে। কখনো-সখনো অবস্থা হয়ে ওঠে উল্টো, ঘড়ির কাঁটাই যেন উল্টো দিকে ঘুরে যায়। এহেন চিত্র দেখে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের একটি গানের লাইন মনে পড়ে যায়ে— ‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার’!
স্বাধীন হওয়ার পরও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক দৈন্যদশা যতখানি হওয়ার নয়, তার চেয়েও বেশি হয়। এসল অনুন্নত দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, রয়েছে বিপুল মানবসম্পদও; কিন্তু সেসল সম্পদের যথাযথ মূল্য তারা পায় না। অর্থাৎ, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জনগণের শোষণ ও বঞ্চনার শেষ নেই!
তাদের সিঁড়ি বানিয়ে উন্নত দেশগুলো ওপরে ওঠে, তারপর সেই সিঁড়ির দিকে আর নজর দেয় না। বরং তৃতীয় বিশ্বের গরিবি দশা থেকে মুক্ত করার নামে তারা অনেক সময় ‘কথিত খুদচাল ঋণ’ দেয়। এতে কোনো রকমে কায়ক্লেশে জীবন বাঁচানো যায় বটে; কিন্তু জীবনমানের উন্নতি হয় না কখনোই। এভাবেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য সকাল আসলেও যেন সূর্যোদয়ের জ্যোতি অধরাই থেকে যায়। স্বাধীনতা অর্জিত হলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, আত্মনির্ভরতা ও সামগ্রিক উন্নয়ন তাদের জন্য যেন সুদূর এক স্বপ্নমাত্র। এই সকল দেশে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হলেও সেই সূর্যে যেন গ্রহণ লেগে যায়, ঢেকে যায়।
ইতিহাসের পরিক্রমায় এই দেশগুলো একাধিক বার শোষিত হয়েছেে—প্রথমে ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা, অতঃপর তথাকথিত উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদের মাধ্যমে। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো একসময় এই দেশগুলোকে সম্পদের আধাররূপে দেখেছে এবং তাদের সব প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদের মতো সম্পদ শোষণ করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পরও এই শোষণের ধারা বন্ধ হয়নি; বরং পরিবর্তিত হয়েছে এক নতুনরূপে। বাংলাদেশের বিপুল মানবসম্পদ স্বল্পমূল্যে শ্রমিকরূপে বিদেশে কর্মরত থেকে উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে, অথচ তাদের প্রাপ্তি ন্যূনতম। প্রদীপের তলায় যেন চিরকাল অন্ধকার থেকে যায়!
প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো মোটেই দরিদ্র নয়। আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার অনুন্নত দেশগুলোর হাতে বিপুল পরিমাণ খনিজ, তেল, কৃষিপণ্য রয়েছে; তারা জনসম্পদেরও অধিকারী; কিন্তু সেই সম্পদ বিভিন্ন কৌশলে উন্নত দেশগুলো যথেচ্ছ শোষণ করে। তারা স্বল্পমূল্যে কাঁচামাল নিয়ে যায় এবং তা প্রক্রিয়াকরণ করে চড়া দামে বিক্রয় করে থাকে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর এই স্থবিরতা কাটাতে চাইলে অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন অপরিহার্য। এক্ষেত্রে এমন একটি আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে, যা এই একবিংশ শতাব্দীর জটিল অর্থনীতির বিশ্বে অত্যন্ত কঠিন কাজ। এর জন্য প্রয়োজন গভীর দেশপ্রেম। পাশাপাশি, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও উন্নয়নের পথ সুগম করা সম্ভব; কিন্তু এইগুলো যেন কেতাবি কথা! কারণ, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যেন ‘ভূরাজনৈতিক মাঠের চাঁদমারি’। আর সেই কারণে ঘড়ির কাঁটা যতই ‘সকাল’ নির্দেশ করুক না কেন, বাস্তবে তৃতীয় বিশ্বের জনগণের জীবনে সেই ‘সকাল’ সহজে আসে না। তাদের জন্য প্রতিটি দিনই হয়- ‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার।’ সত্যিকারের সকাল কবে আসবে, কেউ জানে না।