মার্চ এলেই হাহাকার ভর করে চারপাশে। শিমুল-পলাশের লাল রঙে প্রকৃতি সেজে উঠলেও কোথায় যেন বিষণ্নতার সুর বাজে। বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক অদৃশ্য কষ্ট, হারানোর স্মৃতি, বুকের গভীরে পোড়া দাগ রেখে যাওয়া কিছু নামহীন গল্প।
গ্রামের স্কুলটি এখনো দাঁড়িয়ে, তবে আগের মতো কোলাহল নেই। মাঠে শিশুদের দৌড়ঝাঁপ কমে এসেছে, ক্লাসরুমের জানালাগুলো যেন এক শূন্যতার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেই পুরনো কাঁঠালগাছটার নিচে দাঁড়ালে মনে পড়ে যায় এক বিকেলের কথা।
সেদিন সেখানে বসেই মিতা বলেছিল, ‘যুদ্ধ আসছে। ঘরে বসে থাকার সময় নেই।’
কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, চোখে অগ্নিশিখার মতো তেজ। তখনো যুদ্ধ পুরোপুরি শুরু হয়নি, কিন্তু বাতাসে তার আগমনী বার্তা স্পষ্ট ছিল। মিতার ভাই আগেই চলে গেছে, এবার সে-ও প্রস্তুত।
কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই গিয়েছিল—একটি মেয়ে কীভাবে যুদ্ধে যাবে? সমাজ কি সেটা মেনে নেবে?
মিতা কোনো দ্বিধা রাখেনি। বলেছিল, ‘স্বাধীনতার লড়াইয়ে ছেলেমেয়ের ভেদাভেদ নেই।’
এরপর সে চলে গিয়েছিল, মার্চের শেষের দিকে। গাছের পাতাগুলো সেদিন যেন সাক্ষী হয়েছিল এক অমোঘ সিদ্ধান্তের।
যুদ্ধ শেষ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু মিতা আর ফেরেনি। শহিদদের তালিকায় তার নাম আছে, কিন্তু তার গল্পগুলো হারিয়ে গেছে সময়ের অতল গহ্বরে।
আজ মার্চের বাতাসে আবার সেই স্মৃতি ভেসে ওঠে। শিমুল-পলাশের আগুনরাঙা ফুলের মাঝে যেন মিতার মুখখানা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিদায় বলে কিছু নেই। কিছু নাম, কিছু আত্মত্যাগ ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্মরণ করে সেই ত্যাগের গল্প। মার্চ এলেই সেই নামগুলো হৃদয়ের গভীরে আলোড়ন তোলে, কানে ভেসে আসে সেই কণ্ঠস্বর—‘স্বাধীনতার লড়াইয়ে ছেলেমেয়ের ভেদাভেদ নেই।’