ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি প্রকাশ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আপনি লাখ লাখ মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলছেন।’ তার এই বক্তব্য শুধুই রাজনৈতিক নয়, বরং ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের প্রতিফলনও বটে।
ট্রাম্প ও জেলেনস্কির সম্পর্ক প্রথম থেকেই জটিল ছিল। ২০১৯ সালে যখন ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তার প্রশাসন ইউক্রেনকে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ট্রাম্প এই সহায়তার বিনিময়ে একটি রাজনৈতিক শর্ত জুড়ে দেন। তিনি চেয়েছিলেন, জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন এবং তার ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু করুন। ট্রাম্পের দাবি ছিল, হান্টার বাইডেন ইউক্রেনের একটি গ্যাস কোম্পানিতে দুর্নীতির মাধ্যমে বড় ধরনের ব্যাবসায়িক সুবিধা পেয়েছেন এবং এই অভিযোগ তদন্ত করা হলে বাইডেন পরিবারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, যা ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনে সহায়ক হতে পারে।
কিন্তু জেলেনস্কি এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। তার মতে, ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির অংশ করা উচিত নয় এবং তার দেশ কোনোভাবেই বাইডেনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক তদন্ত চালাতে আগ্রহী নয়। এই সিদ্ধান্ত ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ করে তোলে, কারণ তিনি আশা করেছিলেন, জেলেনস্কি তাকে এই কৌশলে সহায়তা করবেন। জেলেনস্কির অস্বীকৃতি ট্রাম্পের জন্য বড় একটি ধাক্কা হয়ে দাঁড়ায় এবং এরপর যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু করে। যদিও সিনেট তাকে দোষী সাব্যস্ত করেনি, এই ঘটনাটি তার ভাবমূর্তির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ট্রাম্প এখনো মনে করেন, জেলেনস্কি তার প্রতি অবিশ্বস্ত ছিলেন এবং রাজনৈতিকভাবে তাকে বিপদে ফেলেছেন।
ইউক্রেনের প্রতি ট্রাম্পের এই নেতিবাচক মনোভাবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো তার রাশিয়াপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বরাবরই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসা করে এসেছেন এবং একাধিকবার বলেছেন, পুতিন একজন শক্তিশালী নেতা। ২০১৮ সালে তিনি প্রকাশ্যে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলকে সমর্থন করেন এবং বলেন, ‘ক্রিমিয়ার বেশির ভাগ মানুষ রুশ ভাষায় কথা বলে। তাই রাশিয়ার এই অঞ্চল দখল করা অন্যায় কিছু নয়।’ ট্রাম্পের এই বক্তব্য রাশিয়ার আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়ার এক প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছিল, যা ইউক্রেন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এখন প্রশ্ন হলো, ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গি ইউক্রেনের জন্য কী ইঙ্গিত বহন করে? প্রথমটি হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা কমে যেতে পারে, কারণ ট্রাম্প মনে করেন, ইউক্রেনের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থি। তিনি বরং এই অর্থ মার্কিন অর্থনীতির উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে চান। তাছাড়া, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করতে চাইতে পারেন, যেখানে ইউক্রেনকে বড় ধরনের আপসের মুখে পড়তে হতে পারে, যেমন দনবাস অঞ্চল বা অন্যান্য ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়া। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকেই দায়ী করেছেন এবং বলেছেন, ইউরোপের দেশগুলোর উচিত নিজেদের প্রতিরক্ষা খরচ নিজেদের বহন করা, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর না করা।
এই পরিস্থিতি ইউক্রেনের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। যদি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন কমে যায়, তাহলে ইউক্রেনকে শুধু ইউরোপীয় দেশগুলোর সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলো নিজেরাই অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে এবং তারা দীর্ঘ মেয়াদে ইউক্রেনকে আগের মতো সমর্থন দিতে পারবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
জেলেনস্কির জন্য এটি আরো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, তিনি যদি পশ্চিমা সমর্থন হারান, তাহলে তার সরকারের ওপর দেশীয় চাপ বাড়তে পারে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হতে পারে। জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কেন তিনি যুদ্ধের একটি কূটনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছেন। একই সঙ্গে, রাশিয়া আরো সাহসী হয়ে উঠতে পারে, কারণ তারা বুঝতে পারবে যে ইউক্রেন আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাচ্ছে। পুতিন যদি মনে করেন, পশ্চিমারা ইউক্রেন থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে, তাহলে তিনি আরো আগ্রাসী হতে পারেন এবং ইউক্রেনের নতুন নতুন অঞ্চল দখলের চেষ্টা করতে পারেন।
এদিকে ট্রাম্প শান্তি আলোচনার জন্য প্রায় প্রতিটি রাশিয়াপন্থি শর্ত মেনে নিয়েছেন, এমনকি রাশিয়ার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগেই। ট্রাম্প স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ইউক্রেনের জন্য আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড ফেরত আনার দাবি তিনি সমর্থন করবেন না। তিনি ন্যাটোর কোনো শান্তিরক্ষী বাহিনী ইউক্রেনে পাঠানোর সম্ভাবনাও খারিজ করে দিয়েছেন। এমনকি ইউক্রেনের আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহণ এবং ভবিষ্যতে ন্যাটোতে যোগদানের সম্ভাবনা নিয়েও তিনি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন।
এই মনোভাবের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর দিক হলো ট্রাম্পের মন্তব্য, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘কে জানে, হয়তো একদিন ইউক্রেন রাশিয়ার অংশ হয়ে যাবে!’ এটি একদিকে পুতিনের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিশ্বের জন্য একটি বড় ধাক্কা।
ট্রাম্প কেবল রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতেই চাচ্ছেন না, উপরন্তু মস্কোর ওপর আরোপিত কঠোর নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করার পক্ষেও কথা বলেছেন। এমনকি রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য শুরু করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন তিনি, যা পশ্চিমা বিশ্বের জন্য একটি বিস্ময়কর পরিবর্তন! মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ ধরনের অবস্থান ইউক্রেনের জন্য তো বটেই, ন্যাটো এবং গোটা ইউরোপীয় ভূখণ্ডের নিরাপত্তার জন্যই গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। তিনি পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন, রাশিয়া যদি কোনো ন্যাটো দেশ আক্রমণ করে, যুক্তরাষ্ট্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না। এটি ন্যাটোর ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি ‘একজনের ওপর আক্রমণ মানেই সবার ওপর আক্রমণ’ নীতির সরাসরি লঙ্ঘন।
ট্রাম্পের সমর্থকরা অবশ্য এই পরিবর্তনকে যুক্তিসংগত হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। তাদের মতে, ট্রাম্পের লক্ষ্য হলো ইউরোপকে তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষার জন্য আরো বেশি ব্যয় করতে বাধ্য করা। সেসঙ্গে রাশিয়াকে চীনের প্রভাব থেকে দূরে সরিয়ে এনে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করা।
এই নীতির মাধ্যমে ট্রাম্প ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে আরো দুর্বল করে তুলছেন এবং একই সঙ্গে রাশিয়ার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করছেন। পুতিনের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য ছিল পশ্চিমা বিশ্বকে বিভক্ত করা, বিশেষ করে ন্যাটো জোটকে দুর্বল করা এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ইউরোপ থেকে আলাদা করা। ব্রেক্সিট যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাঙনের একটি বড় ধাক্কা দিয়েছিল, তখন পুতিন খুশি হয়েছিলেন। একইভাবে, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়াপন্থি নীতির উত্থানও তার পরিকল্পনার পক্ষে কাজ করছে।
এই পরিবর্তন শুধু আন্তর্জাতিক কূটনীতি নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বিরাট পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ইউরোপীয় নেতারা যখন ট্রাম্পের প্রশাসনের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করেন, তখন তারা শুধু তার রাশিয়াপন্থি নীতিই দেখেন না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে তার রাজনৈতিক পরিকল্পনাও বোঝার চেষ্টা করেন। পুতিন যদি যুক্তরাষ্ট্রকে অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল করতে চাইতেন, তাহলে তিনি ঠিক যেসব পদক্ষেপ নিতেন, সেগুলোই ট্রাম্প বাস্তবায়ন করছেন। ট্রাম্প ইতিমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়েছেন, সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দুর্বল করে দিয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোকে প্রায় গুঁড়িয়ে দিয়েছেন।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ইউক্রেন ও ইউরোপ এই নতুন বাস্তবতাকে কীভাবে সামলাবে? পশ্চিমা বিশ্বের ঐক্য কি রক্ষা করা সম্ভব হবে, নাকি এটি আরো দুর্বল হয়ে পড়বে? ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তার ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের ছেড়ে অন্যদিকে মোড় নিতে চলেছে। যদি এটি সত্য হয়, তাহলে তা শুধু ইউক্রেনের জন্য নয়, বরং গোটা পশ্চিমা বিশ্বের জন্য বড় অশনিসংকেত হয়ে উঠতে পারে।
লেখক : ইন্ডিপেনডেন্টের ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স এডিটর
দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট থেকে অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল মামুন