শৈশব থেকে তানিয়ার স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে, কিন্তু পরিবারের অস্বচ্ছলতা তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পড়ালেখার পরিবর্তে পরিবার তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে চায়। তবে তানিয়ার শক্ত মনোবল হার মানেনি। নিজের চেষ্টায় আয়ের পথ খুঁজে বের করে এবং নিজের বাল্যবিবাহকে ঠেকিয়ে দেয় তানিয়া! আরেক যোদ্ধা রুবিনার সাফল্যগাথাও আমাদের জানা। ‘ইয়ুথ-লেড ইনোভেশন ল্যাব, ২০২১’ প্রতিযোগিতার প্রাইজমানি দিয়ে ‘স্বপ্নকন্যা’ উদ্যোগের মাধ্যমে এখন সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দিচ্ছেন রুবিনা। তানিয়া-রুবিনাদের সংগ্রামের গল্পগুলো আমাদেরকে ভাবায়, তাদের একেকটি মহাকাব্যিক সাফল্য আমদেরকে আন্দোলিত করে, আশা-সম্ভাবনার পথ দেখায়। সাহস জোগায় এগিয়ে যাওয়ার।
নারীর ক্ষমতায়নে পৃথিবীব্যাপী নানান কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিতে তৈরি হচ্ছে নতুন আইন, নীতিমালা। আর তা বাস্তবায়ন হচ্ছে একদম প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত। এর পরও লিঙ্গবৈষম্য রোধে আমাদের হিমশিম অবস্থা! ইউএন ডেসা এবং ইউএন উইমেনের এক যৌথ রিপোর্টে বলা হয়েছে, লিঙ্গীয় সমতা নিশ্চিত করতে যেভাবে কাজ চলছে, তাতে আরো প্রায় ৩০০ বছর লাগবে বৈষম্য দূর হতে। কী অদ্ভুত কথা!


আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন :নারী ও কন্যার উন্নয়ন’। এ বছর ১১৪তম আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে। একই সঙ্গে বেইজিং ডিকলারেশনেরও ৩০ বছর পূর্তি হলো। এ উপলক্ষ্যে তিনটি বিশেষ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ—নারী ও মেয়ে শিশুর অধিকার, লিঙ্গসমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন।
এই তিন ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি কী? পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক রিপোর্টে জানা যায়, শুধু ২০২৩ সালেই বিশ্বের প্রায় ৬১২ মিলিয়ন নারী ও মেয়ে শিশু ১৭০টি সশস্ত্র সংঘাতের সম্মুখীন হয়, যা গত দশ বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। নারী ও মেয়ে শিশুর শিক্ষার অবস্থাও নাজুক! ‘জিসিপিইএ’ ২০২২-২৩ সালে এমন ১০টি দেশকে চিহ্নিত করেছে, যেখানে নারী ও মেয়ে শিশুরা তাদের লিঙ্গপরিচয়ের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। ইউনিসেফের ডাটা বলছে, ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১৯ মিলিয়ন মেয়ে শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের পর বাংলাদেশে ৫ লাখ ১১ হাজার ৫৩৪ শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, যার ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ হলো মেয়ে।
বেইজিং ডিকলারেশনের একটি বৈশ্বিক টার্গেট ছিল রাজনীতিতে নারী ও পুরুষের সমান অন্তর্ভুক্তি, নারী নেতৃত্ব তৈরি করা। তবে তিন দশক পার হয়ে গেলেও এ লক্ষ্যমাত্রা থেকে যোজন-যোজন দূরে আছি আমরা। ইউএন উইমেনের গ্লোবাল ডাটা-২০২৪ থেকে জানা যায়, বিশ্বের ১১৩টি দেশ কখনোই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব দেখেনি। বিশ্বব্যাপী জাতীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে মাত্র ২৭ শতাংশ ছিলেন নারী, মন্ত্রিসভায় নারীদের উপস্থিতি ছিল মাত্র ২৩ শতাংশ।
কর্মক্ষেত্রে নারীর অন্তর্ভুক্তি আগের তুলনায় বেড়েছে বটে, কিন্তু অগ্রগতি কতটুকুু, তা এক প্রশ্ন! ২০২৩ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের উইমেন, বিজনেস অ্যান্ড ল ইন্ডেক্স থেকে জানা যায়, জেন্ডার সমতা বাস্তবায়নে বিভিন্ন দেশে সংস্কার-কর্মের যে পরিস্থিতি, সে অনুযায়ী, আজ যদি কোনো নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তাহলে পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করার আগেই তার রিটায়ারমেন্টের সময় হয়ে যাবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্যনুযায়ী, বোরো মৌসুমে নওগাঁ জেলায় প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার নারীশ্রমিক কৃষিকাজ করে থাকেন। সেক্ষেত্রে একজন নারী যেখানে দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা মজুরি পান, সেখানে একই কাজের জন্য পুরুষশ্রমিক পান ৭০০-৮০০ টাকা। এটা সত্যিই দুঃখজনক।
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের প্রশ্নেও দৃশ্যমান পরিবর্তন নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। জাতিসংঘের এক রিপোর্ট অনুযায়ী—নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার মাত্রা ২০২২ সালের তুলনায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় ২০২৩ সালে। আইন ও সালিশ কেন্দের এক সাম্প্রতিক জরিপে রাজশাহী ও গাজীপুরে ৪৯ শতাংশ নারীর শারীরিক, মানসিক ও যৌন সহিংসতার নানা অভিজ্ঞতার চিত্র উঠে এসেছে। ঐসব নারীর দাবি, যৌন হয়রানির ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে কর্মস্থলে ও গণপরিবহনে।
সত্যি বলতে, ঘরে বাইরে, সমাজে বা রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রটি নারীর জন্য এখনো অবারিত হয়ে ওঠেনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্যের সিদ্ধান্তে তাদের জীবন-জীবিকা পরিচালিত হয়। স্মর্তব্য, নারীর ক্ষমতায়ন মানে শুধু তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নয়, বরং সব ক্ষেত্রে নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতাকেও বোঝায়। আর তাই নারীর ক্ষমতায়নের অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও সম্মিলিতভাবে কাজ করে যেতে হবে। নারীর জন্য সাধারণ ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থাকে সহজতর করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবস্থাকে করে তুলতে হবে নারীবান্ধব। সর্বোপরি খেয়াল রাখতে হবে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রতিটি সেক্টরে নারীরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে এগিয়ে যেতে পারেন। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানোও অনেক বেশি জরুরি।
একটা কথা প্রায়ই বলা হয়, ‘নারীদের চলার পথটি তৈরি করে দেওয়ার দরকার নেই, বরং তাদের চলার পথের বাধাগুলো দূর করে দিতে পারলেই ‘নিজেই নিজের পথ’ তৈরি করে নিতে পারবেন তারা। নারীরা বারবার সেটা প্রমাণও করে দেখিয়েছেন। নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাক বাংলার নারীসমাজ—নারী দিবসে এটাই প্রত্যাশা।
লেখকদ্বয় :যথাক্রমে সেভ দ্য চিলডেনের
জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন বিষয়ক উপদেষ্টা এবং স্ক্রিপ্টরাইটিং ট্রেইনি