শিশুধর্ষণ একসময় সমাজে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু এখন আর তা বিচ্ছিন্ন বিষয় বলে মনে করা হয় না। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতার হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি মাগুরায় মাত্র আট বছরের একটি শিশুকে তার পরিবারেরই এক সদস্য ধর্ষণ করেছে। তবে এই শিশুর ধর্ষণের যেই লোমহর্ষক বর্ণনা তার বড় বোন মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করেছে, তাতে যে কোনো সংবেদনশীল মানুষ কেঁপে উঠবে। শিশুটির বড় বোন ও মায়ের অভিযোগ অনুসারে শিশুটির দুলাভাইয়ের সহায়তায় দুলাভাইয়ের বাবা অর্থাত্ বোনের শ্বশুর শিশুটিকে ধর্ষণ করেন। বিষয়টি ধর্ষকের স্ত্রী ও তার অন্য ছেলেও জানতেন। ধর্ষণের ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে তারা শিশুটিকে হত্যাচেষ্টাও চালান। এই লেখাটি যখন লিখছি, শিশুটি তখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে, শিশুটির জ্ঞান ফেরেনি।
এটি নিছক একজন বিকৃতমনা ব্যক্তির অপরাধ নয়; বরং এটি আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোর চূড়ান্ত ব্যর্থতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। এই অপরাধের ভয়াবহতা কেবল ধর্ষণের শিকার শিশুটির শারীরিক ক্ষত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে না। এটি তার মানসিক গঠনকেও চিরতরে বিকৃত করে দেয়, তার শৈশব কেড়ে নেয় এবং তাকে এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু এর চেয়েও বড় যে সত্যটি সমাজকে প্রতিনিয়ত লজ্জিত করে, তা হলো এই অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। অপরাধীরা শাস্তির মুখোমুখি হয় না এবং পরিবার ও সমাজ অনেক সময় নির্যাতিত শিশুকেই দোষারোপ করে। ফলে ধর্ষণের শিকার শিশুর বিচার পাওয়ার আশা ম্লান হয়ে যায়, আর অপরাধীরা আরো সাহসী হয়ে ওঠে। শিশুধর্ষণের পেছনে নানা মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক কারণ কাজ করে।
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষকের মানসিক বিকৃতি থাকে, যা প্যারাফিলিক ডিজঅর্ডার নামে পরিচিত। প্যারাফিলিয়া আবার কয়েক ধরনের হয়: পেডোফিলিয়া, ফেটিশিজম, ফ্রটারিজম, এক্সিবিশনিজম, ভয়েরিজম এগুলো অন্যতম। পেডোফিলিয়া ডিজঅর্ডারে আক্রান্তরা শিশুদের ওপর যৌন আক্রমণ চালায় বা বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হয়। ফেটিশিজম আক্রান্তরা সাধারণত বিপরীত লিঙ্গের, পোশাক, অন্তর্বাস, জুতা-মোজা বা এ জাতীয় বস্তুতেই যৌন আগ্রহী হয়ে উঠে। ফ্রটারিজম ডিজঅর্ডারনেসের কারণে পুরুষরা ভিড়ের মধ্যে বা সহজে চিহ্নিত করা যাবে না এমন স্থানে মেয়েদের শরীর স্পর্শ করে যৌনতার আনন্দ পায়। এক্সিবিশনিজম হলো অপরিচিত কাউকে বা জনসম্মুখে নিজের গোপনাঙ্গ দেখিয়ে যৌন তৃপ্তি পাওয়া। ভয়েরিজম হলো গোপনে কারো নগ্ন বা অর্ধনগ্ন শরীর বা কারো যৌন কর্ম দেখে সুখ অনুভব করা; যেমন কোনো মেয়ে পোশাক পালটাচ্ছে বা গোসল করছে, আর কোনো ছেলে সেটা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে তার যৌন ক্ষুধা মেটাচ্ছে।
শিশু ধর্ষণের কথা এলেই পেডোফিলিয়া (Pedophilic Disorder) নামক এক বিশেষ মানসিক ব্যাধির কথা উঠে আসে। এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে এক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে এবং এই প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। তবে এই ব্যাধি থাকলেই যে অপরাধ সংঘটিত হবে, তা নয়। কিন্তু সমাজ যখন অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, তখন এই বিকৃত প্রবৃত্তি সহজেই বাস্তব রূপ নেয় এবং দুর্বল শিশুরাই তার প্রধান শিকার হয়।
এছাড়াও আরো কয়েক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক অসুখ ধর্ষণের পেছনে দায়ী। যেমন—অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। এই অসুখে ভোগা মানুষ সাধারণত আইন, নৈতিকতা বা সামাজিক নিয়ম-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। তারা অন্যের প্রতি সহানুভূতি অনুভব করে না এবং অপরাধ করেও অনুশোচনা করে না। এরপর স্যাডিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। এই মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অন্যকে শারীরিক বা মানসিকভাবে কষ্ট দিয়ে আনন্দ লাভ করে। শিশু ধর্ষকদের অনেকেই এ ধরনের প্রবণতায় আক্রান্ত, যেখানে তারা শিশুদের দুর্বলতা এবং অসহায়ত্বকে তাদের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। আরো রয়েছে কমপালসিভ সেক্সুয়াল বিহেভিয়র ডিজঅর্ডার। এটি এমন একটি মানসিক অবস্থা যেখানে ব্যক্তি যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এটি কখনো কখনো পর্নোগ্রাফির অতিরিক্ত আসক্তি, বিকৃত যৌন কল্পনা এবং শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণের মতো ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে রূপ নেয়। শিশুধর্ষণের আরো একটি কারণ হলো সমাজে যৌন শিক্ষার অভাব। যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা না করাকে আমরা সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করি, কিন্তু এই নীরবতাই শিশুদের আরো বেশি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। শিশুদের ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ সম্পর্কে শেখানো হয় না, ফলে তারা বুঝতে পারে না কখন তারা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
দেশে ধর্ষণের শিকার শিশুদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মতো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। অনেক ক্ষেত্রে মামলার দীর্ঘসূত্রতা, অপরাধীর প্রভাবশালী অবস্থান এবং ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতি সামাজিক চাপের কারণে বিচারের আশা নষ্ট হয়ে যায়। অনেক শিশুধর্ষণের মামলাই বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, আর অপরাধীরা সমাজে অবাধে বিচরণ করে। এতে অপরাধীদের মধ্যে ভয় কাজ করে না, বরং তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আরো বড় অসুবিধা হলো আমাদের আইনে আজও ধর্ষিতাকে প্রমাণ দিতে হয় যে তিনি ধর্ষিত হয়েছেন! ধর্ষণের ঘটনা শিশুদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে চিরস্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন করে। অনেক শিশু এই ঘটনার পর থেকে প্রচণ্ড ট্রমার মধ্যে চলে যায়, যার ফলে তারা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা বিষণ্নতা, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD), এবং আত্মহত্যাপ্রবণতার শিকার হয়। শারীরিকভাবেও তারা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যার মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত, সংক্রমণ এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রজননজনিত জটিলতা।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সমাধান শুধু আইনের কঠোর প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি প্রতিরোধের জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরে কাজ করতে হবে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শিশুধর্ষণের মামলাগুলোকে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে, যাতে অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় এবং ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়। পরিবারে শিশুদের সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা ভয় না পেয়ে যে কোনো সন্দেহজনক ঘটনা মা-বাবার সঙ্গে শেয়ার করতে পারে। শেখাতে হবে কোনটা ভালো স্পর্শ কোনটা খারাপ। এসব ক্ষেত্রে প্রতিবাদী হওয়ার সাহস তৈরি করতে হবে শিশুদের মধ্যে, যাতে তারা নিজেদের সুরক্ষা করতে শেখে। পারিবারিক ধর্ষণের ঘটনাগুলো আরো ভয়াবহ, কারণ এই ক্ষেত্রে অপরাধী পরিবারের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। শিশুটির নিকটজন তার অসহায়তাকে পুঁজি করে এই ঘৃণ্য অপরাধে লিপ্ত হয়। কিন্তু আরো ভয়ংকর হলো, অনেক সময় পরিবারের কিছু নারী সদস্যও এই অপরাধের সহযোগী হয়ে ওঠেন। মা, দাদি, কিংবা খালা অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন, কারণ তারা মনে করেন, এই ঘটনা প্রকাশ পেলে পারিবারিক ‘সম্মান’ নষ্ট হবে। অনেকে সামাজিক লজ্জা, স্বামীর প্রতি নির্ভরশীলতা বা পারিবারিক কাঠামো রক্ষার অজুহাতে ধর্ষিত শিশুকেই চুপ থাকতে বাধ্য করেন।
সুতরাং ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে, কারণ, অপরাধীকে আড়াল করা মানে নতুন অপরাধের জন্ম দেওয়া। পরিবার যদি নিজেদের সম্মান রক্ষার নামে ধর্ষকের পক্ষ নেয়, তবে তা শুধু একটি শিশুর জীবনকেই ধ্বংস করে না; এটি পুরো সমাজকে আরো ভয়ংকর করে তোলে।
ধর্ষণের শিকার একটি শিশু কেবল একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির ব্যর্থতার শিকার। সমাজ যদি এখনো ঘুমিয়ে থাকে, তবে এর মূল্য শুধু ভুক্তভোগী শিশুরাই দেবে না, মূল্য দিতে হবে গোটা জাতিকে। গোটা জাতি অসুস্থতার দিকে ধাবিত হবে। শিক্ষায়, প্রশিক্ষণে, প্রতিরোধে, আত্মরক্ষার কৌশলে ঘরে ঘরে তিলোত্তমাদের জাগিয়ে তুলতে হবে; জেগে উঠতেই হবে। ঘুমিয়ে থাকার আর সময় নেই। নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পায় না।
লেখক : গবেষক, মেডিক্যাল হিউম্যানিটিজ ও ট্রমা স্টাডিজ