মাগুরার একটি আট বছরের মেয়ের ঘটনা পুরো জাতিকে স্তব্ধ করেছে। তার জীবন নির্মমভাবে শেষ হয়েছিল, যখন তার বোনের শ্বশুর তাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর শিশুটি গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলে পরবর্তী সময়ে অচেতন অবস্থায় তাকে ঢাকা সিএমএইচে স্থানান্তরিত হয়, যেখানে একাধিক কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর ১৩ মার্চ দুপুর ১টার দিকে (নির্যাতনের আট দিনের মধ্যে) দুঃখজনকভাবে মারা যায়। সিএমএইচে সর্বোচ্চ চিকিত্সাসেবা এবং দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রার্থনা সত্ত্বেও সবাইকে সম্মিলিতভাবে অপরাধী করে নিষ্পাপ শিশুটি মেয়ে হয়ে ওঠার আগেই পরকালবাসী হয়েছে। এই তার এই অকালমৃত্যুতে গোটা জাতি শোকে স্তব্ধ। শিশুটিকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না, এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু হতে পারে না।
আলোচিত এই ঘটনাটিই একমাত্র ঘটনা নয়, বরং এটি আমাদের সমাজের বিস্তৃত সহিংসতার একটি ভয়ানক চিত্র। ধর্ষণ এবং নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা একটি গভীর সামাজিক সমস্যা হয়ে উঠেছে, যার সমাধান এখন সময়ের দাবি। সমাজের প্রতিটি স্তরে এই সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করা দরকার। দেশব্যাপী, নিরীহ নির্যাতনের এমন অনেক গল্প অব্যাহতভাবে সামনে আসছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের রাতে (৮ মার্চ), ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক গর্ভবতী নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। ১১ মার্চ, মানিকগঞ্জে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে তিন বছরের একটি মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। পরপর এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা দেখা যাচ্ছে স্যোশাল মিডিয়ায় এবং সংবাদে, যা সমাজের সুস্থধারাকে বিচলিত করছে।
আরো উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে (প্রায় ৮৫ শতাংশ), অপরাধী হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ভুক্তভোগীর পরিচিত একজন আত্মীয়, পারিবারিক বন্ধু, বা সমাজের বিশ্বাসযোগ্য সদস্য। এই গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত সমস্যা দুঃখজনকভাবে যে সত্যটি প্রকাশ করে তা হলো ধর্ষণের হুমকি শুধু বাইরের নয়, গৃহভ্যন্তরেও। এটি সেই স্থানগুলোতে লুকিয়ে থাকে, যা আসলে ভালোবাসা, যত্ন এবং সুরক্ষা প্রদান করা উচিত ছিল। ঘর, স্কুল এবং কর্মস্থলে আমরা যাদের প্রতি বিশ্বাস রাখি, তারা বারবার আমাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করে, যার ফলে বিধ্বংসী পরিণতি ঘটে।
যৌন সহিংসতার বিস্তার অনেক কারণে হতে পারে। আইনি ব্যবস্থা ধীরগতি, এবং ন্যায়বিচার প্রায়ই অস্বীকার করা হয় বা বিলম্বিত হয়। অপরাধীরা গ্রেফতার হলেও, অনেক সময় মামলা কাগজপত্রের জটিলতায় আটকে পড়ে এবং আইনের ফাঁকফোকরে ও সামাজিক-রাজনৈতিক চাপে বেশির ভাগ অপরাধী জামিনে মুক্ত হয়ে যায়, যা আরো বেশি অসহায়ত্বের অনুভূতি সৃষ্টি করে। তবে সমস্যা শুধু আইনি প্রক্রিয়ার অকার্যকারিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি সামাজিক মনোভাবও, যা বেঁচে থাকা ভুক্তভোগীদের পুনরায় নির্যাতনের শিকার হতে সাহায্য করে। বেঁচে থাকা মানুষরা প্রায়ই ভয়ে, লজ্জিত হওয়া বা সমাজ থেকে নিষিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কায় জীবন যাপন করেন। নীরবতা, লজ্জা এবং বিলম্বিত ন্যায়বিচারের এই মারাত্মক চক্র ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতাকে আরো তীব্র করে তুলছে। তবে, আমাদের সবারই যে প্রশ্নটি করা উচিত তা হলো :আমরা কতদিন এই সংকটকে উপেক্ষা করে যাব? বাস্তবতা স্পষ্ট : ধর্ষণ শুধু একটি অপরাধমূলক সমস্যা নয়; এটি একটি গভীরভাবে শিকড় গেঁথে থাকা সামাজিক সমস্যা। এবং এর সমাধানের জন্য প্রয়োজন একটি বহুস্তরীয় দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতার প্রতিফলন হিসেবে স্বীকার করতে হবে। সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকদের একত্রিত হয়ে এর মোকাবিলা করতে হবে।
আইনি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা উচিত, যাতে অপরাধীদের দ্রুত এবং নিশ্চিত ন্যায়বিচার প্রদান করা যায়। আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগিক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি। তাছাড়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরকে এসব মামলা সহানুভূতির সঙ্গে এবং জরুরি ভিত্তিতে পরিচালনা করার জন্য প্রশিক্ষণ ও উত্সাহিত করা প্রয়োজন। ভুক্তভোগীদের প্রতিটি ধাপে সহায়তা নিশ্চিত করা উচিত, যাতে তারা আইনি প্রক্রিয়ায় পুনরায় মানসিক আঘাতের শিকার না হন।
কেবল আইনি সংস্কারই যথেষ্ট নয়। আমাদের সেই সামাজিক মানদণ্ড এবং মনোভাবেরও চ্যালেঞ্জ করতে হবে, যা নারীদের এবং শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা অব্যাহত রাখে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের ছোটবেলা থেকেই সম্মান, সমতা এবং সম্মতির মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। স্কুল এবং কমিউনিটি সংগঠনগুলিকে ছেলে এবং মেয়েদের স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক, সম্মতির গুরুত্ব এবং যৌন সহিংসতার বিধ্বংসী পরিণতি সম্পর্কে শিক্ষিত করতে হবে। অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমাজনেতাদের উচিত এমন ভূমিকা পালন করা, যা সহানুভূতি, সম্মান এবং সুরক্ষার গুরুত্ব শিখিয়ে দেয়।
একইভাবে, নীরবতা ভাঙার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের কথা বলতে পারে। ধর্ষণের সমস্যা খোলামেলা এবং সততার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য জনসচেতনতা তৈরি হওয়া প্রয়োজন। কমিউনিটিগুলিকে একত্রিত হতে হবে, যাতে তারা ভুক্তভোগীদের সহায়তা করতে পারে এবং তারা প্রয়োজনীয় চিকিত্সা, মানসিক এবং আইনি সহায়তা পায়।
পুরুষ এবং ছেলেদের এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করা খুব জরুরি। লিঙ্গবৈষম্য এবং বিষাক্ত পুরুষত্ব নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিস্তার ঘটানোর প্রধান কারণ। পুরুষ এবং ছেলেদের সমাধানের অংশ হতে হবে, নারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে হবে এবং পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুধু নারীদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না; এটি মানবতার এবং সবার মর্যাদার সংগ্রাম।
একটি সমাজ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র, মিডিয়া, চলচ্চিত্র এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে নারী এবং শিশুদের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হয়। মিডিয়া আউটলেটগুলোকে জনমত গঠনে এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রচারে একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
এই সংকট আর কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে রাখা যাবে না। আমরা চুপ থাকতে পারি না, এটিকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করতে পারি না বা চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না। এখনই সময় এসেছে কাজ করার। আমাদের সকলকে উঠে দাঁড়াতে হবে, মুখ খুলতে হবে এবং পরিবর্তন দাবি করতে হবে। এটি শুধু নারীদের বিষয় নয়; এটি একটি মানবাধিকার বিষয়, একটি নৈতিক বিষয়, এবং একটি জাতীয় সংকট যা তাত্ক্ষণিক মনোযোগ দাবি করে।
আইন বিদ্যমান, তবে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক দুর্নীতিজনিত কারণে অনেক ক্ষেত্রে এই আইন উপেক্ষিত হয়। বিচার হলেও, ধর্ষণের শিকারদের সমাজে কলঙ্কের বোঝা নিয়ে বাঁচতে হয়, অনেক সময় তাদের বেঁচে থাকার আশা হারিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ঘটছে, এবং অনেক সময় ধর্ষণের পর নির্যাতিতাকে খুন করার মতো হূদয়বিদারক ঘটনা ঘটছে। আইনের ধীরগতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার বিলম্বের জন্য অনেকেই দায়ী। কয়েক দশক ধরে এই মহামারি চললেও, কোনো সরকারই এর প্রতিরোধে দৃশ্যমান এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যদি দেশের প্রতিটি জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), থানার কর্মকর্তাদের এই মহামারি মোকাবিলায় কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়, তবে কিছুটা হলেও এই সমস্যার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হতে পারে।
এমতাবস্থায়, রাষ্ট্রকে সব নারী ও শিশুদের সুরক্ষা দিতে হবে, বেঁচে যাওয়া মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে, এবং এমন একটি সমাজ গড়তে হবে, যেখানে কারো বিরুদ্ধে সহিংসতা গ্রহণযোগ্য হবে না।
লেখক : নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল : alactg¦gmail.com