কথায় আছে, ‘গুরু মেলে ঘরে ঘরে/ শিষ্য মেলে কপাল জোরে’। অর্থাত্, যথার্থ এবং সঠিক জ্ঞান আহরণ করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন শিষ্য বা ছাত্র পাওয়া সহজ নয়। বড়বিদ্যা গ্রহণ করার মতো গুণ খুব বেশি শিষ্যের থাকে না। একইভাবে আমরা বলতে পারি—‘উত্তর মেলে পৃষ্ঠা জুড়ে/ প্রশ্ন মেলে যোজন দূরে’। অর্থাত্, ঠিকঠাক প্রশ্ন করতেও অনেক যোগ্যতা লাগে। এজন্য প্রশ্ন আমাদের মস্তিষ্কে থাকে না, শত শত মাইল দূরে থাকে। আমরা আসলে প্রশ্ন করতে ভয় পাই। কিংবা বুঝি না, কী প্রশ্ন করব! কারণ, আমাদের ‘পঠন’ সীমিত। আর যতটুকু আমরা পড়ি, তা ক্রিটিক্যালি পড়ি না। আমরা যা পড়ি, ভাসা-ভাসা পড়েই সন্তুষ্ট থাকি। অথচ বই হলো সমাজের মানসিক প্রগতি ও বিপ্লব সাধনের এক শক্তিশালী মাধ্যম। বইয়ের মধ্য দিয়েই মানুষ তার চিন্তার জগেক প্রসারিত করতে পারে, সমাজের মূল কাঠামোর প্রতি ‘প্রশ্ন’ ছুড়ে দিতে পারে এবং পরিবর্তনের পথ খুঁজতে পারে।
বিশ্বের বহু মনীষী সমাজের মূল কাঠামোকে প্রশ্ন করার এবং পরিবর্তন করার জন্য বইয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সক্রেটিস বলেছেন, ‘অপরীক্ষিত জীবন হলো অযোগ্য জীবন।’ এর অর্থ, জীবন ও সমাজকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করার মাধ্যমেই আমরা প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে পারি। আর সেই অনুসন্ধানের হাতিয়ার হলো বই।
গ্রন্থপাঠের মাধ্যমেই ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত হয় এবং তার চিন্তায় গভীরতা আসে। ফরাসি দার্শনিক রুশো বলেছেন, ‘মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলে আবদ্ধ।’ এই শৃঙ্খল থেকে মুক্তির পথও নির্দেশ করে বই। বইপাঠের মাধ্যমে ব্যক্তি তার চিন্তার জগেক মুক্ত করতে পারে এবং সমাজের নানা সমস্যার সমাধান খুঁজতে পারে। প্রকৃত অর্থে, মানুষের সত্যিকারের মুক্তি আসে তার চিন্তা ও উপলব্ধির গভীরতা থেকে। এই গভীরতা অর্জনের জন্য বইপাঠের কোনো বিকল্প নাই।
ফরাসি বিপ্লবের প্রধান অনুপ্রেরণা ছিলেন দার্শনিক ভলতেয়ার, যিনি বলেছেন, ‘মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখাতে হবে।’ এই প্রশ্ন করার ক্ষমতাই মানুষকে শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সক্ষম করে তোলে। বই হলো এই প্রশ্ন করার ক্ষমতা অর্জনের সর্বোত্তম মাধ্যম।
কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা পাঠ্যাভ্যাস ভুলতে বসেছি, যা খুবই পরিতাপের বিষয়। অধিকাংশ মানুষ অগভীর পাঠ ও তথ্যের প্রতিও আকৃষ্ট, যা তাদের জ্ঞানের গভীরতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অগভীর ও ভাসা-ভাসা পাঠ বা জ্ঞান আমাদের ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’ করে তোলে। এতে আমরা সমাজের প্রকৃত সমস্যাগুলো বুঝতে ও সমাধান করতে অক্ষম হয়ে পড়ি। সুতরাং, সামাজিক বিপ্লবের জন্য সত্য ও জ্ঞানের অনুসন্ধান করতে হলে, মানুষকে সুশিক্ষিত করতে হবে এবং সর্বোপরি এক বৃহত্তর ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়তে হলে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতেই হবে। দুঃখজনকভাবে আজকের যুগে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বইপাঠের অভ্যাস হ্রাস পেয়েছে অনেকখানি। মানুষ এখন সহজলভ্য তথ্যের দিকে ঝুঁকছে, কিন্তু তথ্য ও জ্ঞানের মধ্যে তো পার্থক্য রয়েছে: তথ্য কেবল ঘটনার বিবরণ, কিন্তু জ্ঞান হলো তার গভীর উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ।
আমাদের সমাজের রুগ্ণ ও দৈন্যদশা দূর হচ্ছে না—তার মূলেও রয়েছে এই বিষয়গুলো। গভীর পঠনপাঠনের মাধ্যমেই সমাজে শোষণবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠতে পারে। সমাজের প্রকৃত মুক্তির জন্য এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বইয়ের মধ্য দিয়ে মানুষ সচেতন হবে, বইয়ের মধ্য দিয়ে মানুষ পথ খুঁজে পাবে, বইয়ের মাধ্যমেই মানুষের হৃদয় প্রসারিত হবে। মানুষের যে বুদ্ধি—সেই বুদ্ধি সংকীর্ণ থাকবে না, স্বার্থপরতা থাকবে না। সেই বুদ্ধি অন্যের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হবে না। সেই বুদ্ধি মানুষের সামগ্রিক উন্নতির জন্য চেষ্টা করবে।
বস্তুত, বইবিমুখ করার জন্য আমাদের চারিদিকে যাবতীয় রঙের যেই সকল হওয়াই মিঠাই রাখা হয় এবং ক্রিটিক্যালি বই পড়তে নিরুৎসাধিত করা হয়—তার নেপথ্যে রয়েছে আমাদের সমাজকে পিছিয়ে দেওয়ার ‘সুনির্ধারিত পরিকল্পনা’। এই দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা আমরা আর কবে বুঝতে পারব?