দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নতুন ট্রাম্প জামানা ইউরোপের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে অনেক আগে থেকেই মন্তব্য করে আসছেন বিশ্লেষকরা। যদিও সপ্তাহখানেক আগে সাংবাদিক নিকোলাস ভিংকুর হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে বলেন, ‘ট্রাম্প বা কমলা হ্যারিসের মধ্যে যিনিই ক্ষমতায় আসুন না কেন, কয়েক দশকের পুরোনো ইউরোপ—আমেরিকা সম্পর্ক নিশ্চল হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় ইউরোপীয়দের উচিত হবে, ইউএস প্রেসিডেন্সি নিয়ে বেশি চিন্তা করা ছেড়ে দিয়ে বরং নিজেদের বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। বিশ্বের বিপজ্জনক মঞ্চে কীভাবে একা টিকে থাকা যায়, তার প্রস্তুতি গ্রহণ করা।’
ইউরোপে ‘মার্কিন প্রতিশ্রম্নতি’ কমে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা নতুন কিছু নয়। তবে ট্রাম্পের বিজয়ের পর সেই অবজ্ঞাসূচক হতাশা এখন সতর্কতামূলক গল্পে পরিণত হয়েছে। উদ্বেগ—উৎকন্ঠা হয়েছে আরো বেশি গভীর। বিশেষত, ইউরোপের বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এর প্রভাব হবে অত্যন্ত প্রকট।
ইউরোপের জন্য চিন্তার কারণ হলো, ইউক্রেন যদি পুতিনের কব্জায় চলে যায়, তাহলে ‘আক্রমণাত্মক রাশিয়া’ হাজির হবে ইউরোপ ও ন্যাটোর একেবারে দোরগোড়ায়! ঠিক এই বিষয়টিই ভাবিয়ে তুলছে বিশেষত বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলোকে। কারণ, ইউক্রেন হাতছাড়া হয়ে গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলীয় সীমানা ‘খোলা ময়দান’ হয়ে পড়বে, যার ফলে ইউরোপের সামগ্রিক নিরাপত্তা ঢেকে যাবে অস্থিতিশীলতার চাদরে।
প্রথম প্রেসিডেন্সিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও অঞ্চলের সঙ্গে শুল্ক, পালটা—শুল্ক এবং বাণিজ্য যুদ্ধের ঝড় তুলেছিলেন ট্রাম্প। তার দ্বিতীয় মেয়াদে এই ঝড় আরো প্রলয়ংকারী হতে পারে। কারণ, এবারকার নির্বাচনি প্রচারাভিযানের সময় তিনি ভোটারদের যেসব প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন, তা পূরণ করতে গেলে বাণিজ্য যুদ্ধের দামামায় গোটা ইউরোপ জুড়ে তীব্র কাঁপুনি শুরু হবে। সব ধরনের আমদানির ওপর তিনি সম্ভবত ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করবেন। বিশেষ করে, জার্মানি এবং মার্সিডিজ—বেঞ্জের মতো জায়ান্ট কোম্পানিগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করতে পারেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। ক্রমবর্ধমান হারে পণ্য ও সেবা ক্রয়—বিক্রয় হয় এ দুই পক্ষের মধ্যে। ফলে ওয়াশিংটন বাণিজ্যে কড়াকড়ি আরোপ করলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে ইইউভুক্ত দেশগুলো।
এমন একটি অবস্থায় প্রশ্ন হলো, ইউরোপ এক্ষেত্রে কতোটা প্রস্তুত? জানা যায়, ট্রাম্পের ধাক্কা সামলানোর অংশ হিসেবে ইউরোপীয় কমিশন ইতিমধ্যে বেশ কিছু বাণিজ্য, প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বিনিয়োগ সংক্রান্ত কৌশল প্রণয়ন করেছে। উপরন্তু, সম্ভাব্য বাণিজ্য যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক স্বার্থ রক্ষায় আরো নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের পথে কমিশন। প্রযুক্তি খাত, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা এবং কাঁচামালের প্রশ্নে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বাড়ানোর দিকেও কমিশন মনোযোগ দিচ্ছে। তবে মুশকিল হলো, এসব পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিতর্কিত ইস্যুতে জড়িয়ে পড়তে পারে ইইউ। বিগত সময়ে ‘স্টিল ইস্যু (ইস্পাত)’ নিয়ে যে ধরনের বিতর্ক শুরু হয়েছিল দুপক্ষের মধ্যে, ঠিক সেরকম বিভিন্ন নতুন ইস্যু তৈরি হতে পারে।
ট্রাম্পের ইউরোপ বিরোধিতা নতুন কিছু নয়। ইউরোপ—বিদ্বেষ যে তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত প্রবণতা, তেমনও নয়। বরং ওয়াশিংটনে বর্তমানে এমন অনেক নীতিনির্ধারক আছেন, যারা ইউরোপের প্রতি স্বাভাবিক সহানুভূতিপ্রবণ নন। সহজ করে বললে, ইউরোপ বিরোধিতার জন্য কেবল ট্রাম্পকে দায়ী করা ঠিক নয়। বস্তুত, বারাক ওবামা ও জো বাইডেনের আমল থেকেই ওয়াশিংটন স্পষ্টভাবে এবং সম্ভবত স্থায়ীভাবে, ইউরোপ ও ন্যাটোর থেকে মুখ ফিরিয়ে এশিয়ার দিকে এগোতে শুরু করে।
সাম্প্রতিককালে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের মধ্যে ইউরোপে সেনাসংখ্যা কমানোর প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পাশাপাশি ইউরোপের সঙ্গে ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক আগ্রহ হ্রাস পাওয়ার চিত্রও চোখে পড়ার মতো! এর মধ্য দিয়ে পরিস্কার বোঝা যায়, ইউরোপের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব ক্রমশ সহানুভূতিহীন হয়ে পড়ছে। আরো পরিস্কার করে বললে, ওয়াশিংটন—ইইউ সম্পর্ক ‘উদাসীনতা থেকে বিরূপ’ হয়ে উঠছে।
১৯৯৪ সালের শীতল যুদ্ধোত্তর সহযোগিতামূলক অবস্থান থেকে মূলত এশিয়ার দিকে মনোযোগী হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দলীয় পক্ষপাতিত্ব, বিচ্ছিন্নতাবাদ কিংবা ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে জয় লাভের মতো ঘটনাগুলোর মাধ্যমে ‘মার্কিন অভিজাতদের মনস্তত্ত্বে ইউরোপের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের চরম অবনতি’ ঘটে চলেছে।
তবে সাবেক ইউএস সেনা কর্মকর্তা ও কমান্ডিং জেনারেল বেন হজেসের যুক্তি ভিন্ন। তার ভাষ্য, ন্যাটো এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের সম্পর্ক আমেরিকাকে ব্যাপক সুবিধা প্রদান করে। আর এ কারণে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প অবশ্যই এই অংশীদারিত্বকে ত্বরান্বিত করবেন। মূলত, হজেসের যুক্তিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরার ফলে বিশেষ করে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর কপালে পড়ছে চিন্তার ভাঁজ। এসব দেশের আশঙ্কা, উচ্চ হারে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের জন্য তাদের ওপর চাপ দেবেন ট্রাম্প। কিছু বিশ্লেষক অবশ্য মনে করেন, এর ফলে বরং লাভ হবে দেশগুলোরই। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটির পরিচালক ইন্দ্রেক কানিক যেমনটি যুক্তি দিয়েছেন, ‘নিরাপত্তা বা প্রতিরক্ষা খাতে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ৩.৫ থেকে ৪ শতাংশ ব্যয় করে, সেখানে ইউরোপের ১.৫ থেকে ২ শতাংশ ব্যয় করাটা একধরনের ভারসাম্যহীনতা বই আর কিছুই নয়।’
কানিকের বক্তব্য, ‘ইউরোপ তার নিজের প্রতিরক্ষার জন্য বেশি ব্যয় করলে, তথা নিজের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলে, তাতে করে তারই সুবিধা হবে।’ বাস্তবতা হলো, ব্রাসেলসের মধ্যেও এ ধরনের চিন্তা দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সত্যি বলতে, নিজের প্রতিরক্ষার প্রশ্নে ইউরোপের এখনই ‘ঘুম থেকে জেগে ওঠা’র উপযুক্ত সময়।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প ইউরোপের প্রতি এতোটাই শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠবেন যে, এই অঞ্চলের দেশগুলোর সামনে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তাছাড়া ‘পুতিনের আকাঙ্ক্ষার মুখে’ বাল্টিক অঞ্চলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে অর্থায়ন সমস্যার সমাধানের বিষয়টি দেশগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এ ধরনের প্রেক্ষাপটে স্বভাবতই সামনে আসে ন্যাটোকে শক্তিশালী করার প্রসঙ্গ। শুরু থেকেই ন্যাটোর কঠোর সমালোচনা করে আসছেন ট্রাম্প। এর অন্যতম কারণ, ন্যাটোর প্রতিরক্ষা খাতে যুক্তরাষ্ট্র বেশি ব্যয় করলেও বেশিরভাগ সদস্য নির্ধারিত চাঁদা দিতে অনীহা দেখায়। ট্রাম্পের মতে, ‘এই প্রবণতা বাকি সদস্যদের ফ্রি রাইডিংয়ে উৎসাহিত করছে।’
এবারকার নির্বাচনি প্রচারণা জুড়েও ন্যাটোর কড়া সমালোচনা চালিয়ে গেছেন ট্রাম্প। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ন্যাটো মিত্ররা এখনও পর্যাপ্ত ব্যয় করতে চাইছে না।’ এ অবস্থায় ট্রাম্প হুংকার দিয়ে বলেছেন, অর্থ প্রদানে ব্যর্থ দেশগুলোর বিরুদ্ধে রাশিয়ার ‘যা খুশি করা’কে তিনি উৎসাহিত করবেন। ট্রাম্পের এ ধরনের কথার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায় যে, আক্রমণের মুখে যুক্তরাষ্ট্র কি তাহলে ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে না? ওয়াশিংটন কি তবে সত্যি সত্যিই এ সংগঠন ছেড়ে দেবে?
ট্রাম্পের জন্য ইউক্রেন সংক্রান্ত বিকল্প দুইটি—হয় অস্ত্র সরবরাহ করা অথবা সহায়তা প্রত্যাখ্যান করা। যদি প্রথমটি ঘটে, তাহলে যুদ্ধের ময়দানে ঘুরে দাঁড়াবে কিয়েভ। অন্যদিকে, দ্বিতীয়টি ঘটলে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই যুদ্ধে জিতে যাবেন সহসা। ইউরোপের জন্য চিন্তার কারণ হলো, ইউক্রেন যদি পুতিনের কব্জায় চলে যায়, তাহলে ‘আক্রমণাত্মক রাশিয়া’ হাজির হবে ইউরোপ ও ন্যাটোর একেবারে দোরগোড়ায়!
ঠিক এই বিষয়টিই ভাবিয়ে তুলছে বিশেষত বাল্টিক অঞ্চলের দেশগুলোকে। কারণ, ইউক্রেন হাতছাড়া হয়ে গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলীয় সীমানা ‘খোলা ময়দান’ হয়ে পড়বে, যার ফলে ইউরোপের সামগ্রিক নিরাপত্তা ঢেকে যাবে অস্থিতিশীলতার চাদরে।
ট্রাম্পের বিজয়ে কিছু ইউরোপীয় দেশ ভেতরে ভেতরে খুশি হয়েছে বটে। বিশেষত, কট্টর ডানপন্থী দলগুলো উষ্ণতা অনুভব করছে! ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প হয়তোবা হাঙ্গেরি বা ইতালির মতো কট্টর ডানপন্থী সরকারগুলোকে টেনে তুলতে পারেন। তবে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় কমিশন হয়তো দিনশেষে বাস্তববাদী ভূমিকাই পালন করে যাবে।
লেখক : অ্যামেলিয়া হ্যাডফিল্ড। (যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সারের রাজনীতি বিভাগের প্রধান)
দ্য কনভারসেশন থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন