ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে ফেরার কারণে আরব দেশগুলোর প্রত্যাশা ও কৌশল পুনর্মূল্যায়নের বিষয়টি সামনে এসেছে। আগের মেয়াদে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অনেক দিক ঢেলে সাজিয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে বলে মনে হয়না।
প্রথম প্রেসিডেন্সিতে মধ্যপ্রাচ্যে ঐতিহ্যগত কূটনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে বিশেষত ইরানের প্রতি কঠোর অবস্থানমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন ট্রাম্প। ফলে তার প্রত্যাবর্তনের ফলে আরব নেতারা নিশ্চই ট্রাম্প জামানার আগেকার সেসব নীতির দিকে দৃষ্টি দিতে চাইবেন। বিকশিত বা পরিবর্তিত ভূ—রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখার বিষয়কে প্রাধান্য দেবেন। এ ধরনের প্রবণতা বিশ^রাজনীতিতে সরল হিসাব বইকি।
গাজা সংঘাত, লেবাননে ইসরাইলি সামরিক পদক্ষেপ এবং বিশেষত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিসহ বেশ কয়েকটি ইস্যু নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের অ্যাজেন্ডার একেবারে ওপরে থাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়। নতুন মেয়াদে ট্রাম্প পূর্বসূরিদের কতটা ছাড় দিয়ে দেখবেন, তা সময়ই বলে দেবে। কারণ, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফাস্টর্’ নীতির সূত্র ধরে হিসাব করলে, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মার্কিন স্বার্থকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেখবেন বলে মনে হয়। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে মিত্র বা প্রতিপক্ষের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগের পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে। আর সে ধরনের পরিস্থিতিতে আরব দেশগুলোর সামনে সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ উভয়ই হাজির হবে।
প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের সবচেয়ে আলোচিত পদক্ষেপ ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’। এই চুক্তির ফলে ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কোর মধ্যে সম্পর্ক বেশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। পক্ষগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতাও বৃদ্ধি পায়। স্থিতিশীলতার জন্য এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় বটে, কিন্তু এ নিয়ে সমালোচনা থেমে থাকেনি। অনেকের দাবি, ইসরাইল—ফিলিস্তিনি সংঘাতের মতো মূল আঞ্চলিক সমস্যাগুলো সমাধান করার চেয়ে বরং অর্থনৈতিক লাভের জন্যই এ ধরনের চুক্তি করা হয়ে থাকে! সমালোচকরা আরো যুক্তি দেখান যে, ফিলিস্তিন সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের যত উদ্যোগই গ্রহণ করা হোক না কেন, তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বরং তাতে করে এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল স্বভাবতই ‘ইরান’। সেসময় বারাক ওবামা প্রশাসনের উদ্যোগে স্বাক্ষরিত জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। শুধু তাই নয়, ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব সীমিত করার প্রয়াসে তেহরানের ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। কিছু উপসাগরীয় দেশ ট্রাম্পের এ কৌশলকে সমর্থন করেছিল বটে। তবে একটি সময়ে এসে ঠিকই দেখা যায়, এতে করে বরং উত্তেজনা বেড়েছে, বেড়েছে সংঘর্ষের ঝুঁকি। জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা এবং পরবর্তীতে ওয়াশিংটন—তেহরান শত্রুতা বৃদ্ধির মতো ঘটনা ঘটেছিল এর পটভূমিতে।
ট্রাম্প প্রায়শই মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এই অঞ্চলের দ্বন্দ্ব—সংঘাতে আমেরিকার বেশি নাক গলানোকে সরাসরি মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী হিসেবে গণ্য করেন। ২০১৯ সালে উত্তর সিরিয়া থেকে তার মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘটনা এক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত নমুনা।
সিরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ফলে কিছু মার্কিন মিত্রের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক আরব নেতা মার্কিন সামরিক সহায়তার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ঘটনা এতটুকুতেই থেমে থাকেনি! ‘বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ অন্বেষণ করার চিন্তা পর্যন্ত করেছিল কিছু রাষ্ট্র।
অভিযোগ করা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের গৃহীত নীতিগুলো স্পষ্টত ইসরাইলের পক্ষে ছিল। যেমন, ট্রাম্প প্রশাসন জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করে এবং গোলান মালভূমিতে ইসরাইলের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়। ট্রাম্পের এসব উদ্যোগ বিশেষ করে ভালোভাবে নেয়নি ফিলিস্তিনিরা। ফলে তার ‘শান্তি থেকে সমৃদ্ধি’ পরিকল্পনা ফিলিস্তিনিদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। একে তারা পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখান করে।
যাহোক, সংঘাত নিরসনে ‘নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ইসরাইলের কৌশলগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন মূলত আমেরিকার ভূমিকাকে খাটো করে ফেলেছে। এর ফলে এই বিভক্ত অঞ্চলকে আরো মেরুকরণ করা হয়েছে। এমন একটি প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে প্রত্যাবর্তন মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে আরব দেশগুলোর মধ্যে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে আরব দেশগুলো নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিতে ধারাবাহিকতা দেখতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন নীতির ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়তে পারে।
ইতিমধ্যে অন্যান্য আরব রাষ্ট্রে আব্রাহাম অ্যাকর্ডস চুক্তি সম্প্রসারণের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। ফলে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রশ্নে এসব দেশ বিশেষ করে প্রযুক্তি, পর্যটন ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কিছু মার্কিন সুবিধা পেতে পারে। তবে ফিলিস্তিনি ইস্যু নিয়ে ট্রাম্প কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে অনেক আরব দেশ প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে বলে আশঙ্কার অবকাশ রয়েছে। অর্থাৎ, দেশগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা ট্রাম্প এবং তার মিত্র আরব নেতাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে আগামী দিনগুলোতে।
নতুন মেয়াদে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কমানোর চেষ্টা করতে পারেন। এর ফলে আঞ্চলিক দেশগুলোকে নিজেদের প্রতিরক্ষামূলক ক্ষমতা জোরদার করার দিকে নজর দিতে হবে স্বাভাবিকভাবেই। নিরাপত্তা জন্য নতুন জোট গঠন করতে হবে। মার্কিন উপস্থিতি হ্রাস পেলে অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তি, যেমন রাশিয়া ও চীনের হস্তক্ষেপ বাড়তে পারে এ অঞ্চলে।
বৈদেশিক নীতির ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ট্রাম্প অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের জন্য সিদ্ধহস্ত! এ কারণে আরবের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো যদি কোনোভাবে মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকাণ্ড করে বসে, তাহলে আমেরিকার সঙ্গে তাদের দুরত্ব বাড়বে। এ অবস্থায় উপসাগরীয় দেশগুলোকে তেলের উৎপাদনে ‘সামঞ্জস্য’ রাখার জন্য চাপ দিতে পারেন ট্রাম্প, যার ফলে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে।
ট্রাম্প মার্কিন শক্তির স্বাধীনতাকে সমর্থন করলেও বিশ্ব বাজারের আন্তঃসংযোগের প্রেক্ষাপটে আরব তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো ওয়াশিংটনের অর্থনৈতিক কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েই থাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে, ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় ফ্যাক্টর হবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
নির্বাচনি প্রচারণার সময় ট্রাম্প ‘জ¦ালানির মাধ্যমে শান্তি’র ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। আরব ও মুসলিম নেতাদের তিনি এই প্রতিশ্রম্নতিও দিয়েছেন যে, দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হলে এই অঞ্চলের সংঘাতের অবসান ঘটানো হবে। অনেক আরবীয় মনে করেন, ডেমোক্র্যাট হিসেবে বাইডেন গাজায় সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করার জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে চাপ দিতে ব্যর্থ। এক্ষেত্রে ট্রাম্প ভূমিকা রাখতে পারেন।
আরব বিশ্ব জুড়ে ট্রাম্পকে একজন বাস্তববাদী ব্যবসায়ী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এ কারণে অনেকের বিশ^াস, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার স্বার্থেই মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠবে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর বিশ্বাস, ক্রমাগত সংঘাতের মধ্যে উন্নয়ন এবং উন্নত সম্পর্ক বিকশিত হতে পারে না। ‘ব্যবসায়ী ট্রাম্প’ নিজেও জানেন এই বাস্তবতা। এ দিক থেকে দেখলে, গাজা কিংবা লেবাননের সংঘাতের লাগাম টানাই হবে ট্রাম্পের প্রশাসনের মূল লক্ষ্য।
বস্তুত, মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের নীতিতে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে। আরব নেতাদের উচিত হবে, এই সতর্কতাকে সফলভাবে নেভিগেট করা। সম্ভাব্য সুবিধাগুলোর সদ্ব্যবহার করেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার কথা চিন্তা করতে হবে তাদের। যদিও ফিলিস্তিন ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধান না হলে কোনো প্রচেষ্টাই আলোর মুখ দেখবে না।