স্যার বলা না-বলা নিয়ে আমাদের দেশে প্রায়ই বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি মানিকগঞ্জে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তাকে ‘ভাই’ বলে ডাকায় কর্মকর্তাটি রুষ্ট হয়েছেন। তিনি সেই গ্রাহককে বলেছেন, ‘ভাই’ বলেন কেন? ‘ভাই’ বলবেন না। ‘স্যার’ বলতে হবে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের সঙ্গে কর্মকর্তার ধাক্কাধাক্কি পর্যন্ত হয়েছে।
অনেক আমলা আছেন, যারা স্যার সম্বোধন না শুনলে ক্ষেপে যান। অন্য পেশার লোকজনের মধ্যেও স্যার-কাতরতা আছে। তবে এ ব্যাপারে তবে স্যার বলা না-বলা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা পাকান আমলারা। প্রায়ই তারা সংবাদ-শিরোনাম হন এই স্যার-সম্বোধন না করার প্রতিক্রিয়ায়। কথা বলার সময় ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করায় পুলিশ, ইউএনও কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চ বর্ণের লোকের দ্বারা প্রতিনিয়ত সাধারণ নাগরিকের হেনস্থার ঘটনা প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয়।
এতদিন আমলাদের মধ্যেই স্যার সন্বোধন নিয়ে বিশেষ ‘রক্ষণশীলতা’ দেখা গেছে। এখন সেরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যেও এই ‘স্যার’ সম্বোধনের প্রতি দুর্বলতা বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বেশিরভাগ মানুষই আমলা কিংবা অন্য পেশার মানুষদের বাধ্যতামূলক স্যার সম্বোধনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন। এ থেকে বোঝা যায়, স্যার সম্বোধন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ আছে। হয়তো তাদের অনেকের এমন অভিজ্ঞতা আছে-সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রবিশেষে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। সবাই অবস্থার পরিবর্তন আশা করেন।
ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে আমাদের দেশে স্যার সম্বোধনটির চর্চা শুরু হয়। ব্রিটিশরা এ দেশে আমলাতন্ত্রের ভিত গড়ার আগেও এ দেশে প্রশাসন ছিল। তখন পদের নামেই সম্বোধন চলত। রাজা, কাজি, আমিন, তালুকদার, জায়গিরদারদের পদ বা কখনো কখনো বাদশার কাছ থেকে পাওয়া উপাধি বা পদবি দিয়েও সম্বোধন চলত। ব্রিটিশরা নিজের দেশে নাম বা পদ ধরে সম্বোধনের রেওয়াজ চালু রাখলেও উপনিবেশের বাসিন্দাদের প্রভু মানে ‘স্যার’ সম্বোধন শিখিয়েছেন।
মজার বিষয় হচ্ছে, তারা যে শব্দটা উপমহাদেশে প্রচলন করেছিলো সেটা তারা নিজেরাও ব্যবহার করে অনেক স্বল্প পরিসরে। বৃটিশরা কথা বলার সময় অপরিচিত কাউকে শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে স্যার বলে সম্বোধন করে থাকে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকেও মি. প্রেসিডেন্ট সম্বোধন করা হয়। আমাদের দেশে শিক্ষকদের সম্মানসূচক স্যার/ম্যাডাম বলে সম্বোধন করা হয়। কিন্তু যদি কেউ না করে তাতে নিশ্চয়ই উক্ত শিক্ষকের মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার কথা না। কিন্তু আমাদের দেশে স্যার সম্বোধন না শুনলে আমলাদের মতো শিক্ষকরাও অনেক ক্ষেত্রে রুষ্ট হন।
পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের নাগরিকরা নাম ধরে ডাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে স্যার না বললে তোলপাড় ঘটে যায়। অথচ স্যার বা ম্যাডাম বলার কোনো বিধান নেই। কোনো আইনে নেই যে তাকে এটা বলতে হবে। তার পরেও স্যার নিয়ে বাদুনবাদের কোনো ছেদ বা বিরামচিহ্ন পড়েনি। ‘স্যার’ সম্বোধন আদায়ের জন্য ছোট–বড় নারী–পুরুষনির্বিশেষে এক শ্রেণির চাকরিজীবী ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বিষয়টি বিস্ময়করভাবে ছোঁয়াচে হয়ে উঠছে।
ভারতের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু ‘পলিসিমেকারস জার্নাল: ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি’ নামে একটি স্মৃতিচারণামূলক বই প্রকাশ করেন। এই বইয়ে তিনি লিখেছেন, সরকারি কর্মকর্তারা ‘স্যার’ ডাক ভীষণ পছন্দ করেন। বলতেও, শুনতেও। তাই অধস্তনরা কথায় কথায় ঊর্ধ্বতনদের স্যার ডাকেন। কৌশিক বসু বলছেন, ভারতে মিনিটে গড়ে ১৬ বার স্যার শোনার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। একটি সরকারি বৈঠকে তিনি ইচ্ছা করে গুনেছিলেন। ওই বৈঠকে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা সেখানে প্রতি মিনিটে গড়ে ১৬ বার স্যার শব্দ উচ্চারণ করেছেন। এ বিষয়ে কৌশিক বসু বইয়ে লিখেছেন, একবার স্যার শব্দ বলতে যদি আধা সেকেন্ড সময় লাগে, তাহলে ভারতীয় আমলারা তাদের কথা বলার মোট সময়ের ১৩ শতাংশই স্যার শব্দ ব্যবহার করতে ব্যয় করেন। আমলাদের স্যার বলা ও শোনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্রও ভারতের চেয়ে আলাদা নয়। এখানে স্যার স্যার বলে মুখে ফেনা তুলতে না পারলে যথার্থ আমলা হওয়া যায় না! আমাদের দেশে কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও আভিজাত্য বুঝাতে ‘স্যার’ শব্দের প্রচলন শুরু হয় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সময় থেকে। ব্রিটিশরা চলে গেছে, কিন্তু তাদের কুঁচকানো ভুরুটা রয়ে গেছে। কালে কালে ‘স্যারের’ শিকড়টা এমন গভীরে চলে গেছে যে এখন বড় কর্তার সব কথার উত্তর ‘স্যার’ শব্দ দিয়েই দেওয়া যায়। হ্যাঁ বাচক, না বাচক যা–ই হোক এক ‘স্যার’ দিয়ে সেরে ফেলা যায় কথোপকথন।
অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, নড়বড়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলা মানুষের মধ্যে পোশাকি আড়ম্বরের প্রতি একটা ঝোঁক থাকে। যে শিক্ষক ভালো পড়াতে পারেন না, ক্লাসকে আকর্ষণীয় করতে পারেন না, তিনি মারপিট, বকাবকি, হুমকি দিয়ে ক্লাস শান্ত রাখার নিষ্ফল চেষ্টা করেন। কোন ছাত্র কতটা ঝুঁকে সালাম দিল, আর কে দিল না, সেটাই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান বিবেচ্য বিষয়। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল যেমন বলেছেন, ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্যেই দুর্বল মানুষ ক্ষমতার স্বাদ পেতে চায়।’
আমাদের দেশে স্যার বলার ক্ষেত্রে ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। যারা ‘স্যার’ শুনতে অভ্যস্ত, তারা ভাবেন চাকরিতে যেমন বেতন আছে, সুযোগ-সুবিধা আছে, তার সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও জুনিয়র কর্মীর কাছ থেকে ‘স্যার’ ডাক শুনতে পাওয়া একটি অধিকার। আমলাতন্ত্রের মধ্যে যেসব ক্যাডারে কঠোর আনুগত্য-নীতি মেনে চলা হয়, সেখানে এক ব্যাচ ওপরের অফিসারকে জুনিয়র অফিসাররা ‘স্যার’ বলেন। অন্যান্য ক্যাডারে পদোন্নতি পাওয়ার পর পদাধিকারীকে তার নিচের স্তরের সহকর্মীরা ‘স্যার’ বলেন। এ ধারা এ উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে চলে আসছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, যেখানে পদোন্নতির মাধ্যমে ওপরে ওঠার নিয়ম, সেখানে ‘স্যারের’ প্রচলন আগে না থাকলেও এখন শুরু হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকে কাছাকাছি সিনিয়রকে ‘ভাই’ বলে ডাকলেও অনেক ক্ষেত্রে ‘স্যার’ বলা হয়। এটি সরকারি দপ্তরের এক ধরনের অনুকরণ বলা যায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের মধ্যে সম্বোধন হিসাবে ব্যবহৃত হয় ভাই, লিডার, নেতা, নেত্রী, আপা, সিনিয়র ইত্যাদি। তবুও এখানে বেশি সিনিয়রদের ‘স্যার’ বলার রেওয়াজ আছে। ‘স্যার’ ব্যবহৃত হলে যার উদ্দেশে এটি বলা হয়, তিনি খুশি হন। আর খুশি করে ফল-লাভ হলে সে কাজ সবাই করতে চাইবেন, এটাই স্বভাবিক।
তবে এটা ঠিক যে, কাজের সময়ে দপ্তরে সিনিয়রকে ‘স্যার’ বলার রেওয়াজ থাকা দোষের কিছু নেই। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিজেদের ভেতরে প্রতিষ্ঠানের ভালোর জন্য যে সম্বোধন প্রযোজ্য, তা থাকলে অন্যদের কিছু বলার নেই। কিন্তু ‘স্যার’ বলার ক্ষেত্রটি প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রমান্বয়ে চারদিকে প্রসারিত হয় বলেই কথা ওঠে। অফিসে যারা আসেন, তাদের সেখানে কোনো কাজ থাকলেই অনেক অফিসার ভাবেন, এর কাছ থেকে ‘স্যার’ ডাক শুনতে পাওয়া তার পাওনা। ডাকে ঘাটতি পড়লে তখন কাজ করে দেওয়ায় ঘাটতি পড়ে, এমন অভিযোগ আছে। স্যার যারা বলেন না, তাদের নানাভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয় ‘স্যার’ বলা দরকার। অন্যদিকে ‘স্যার’ বলে যদি কাজ করে নিতে সহজ হয়, তাহলে অপরদিক থেকে সেটা বলার প্রতি আগ্রহ বাড়ে।
কিন্তু ‘স্যার’-এর ব্যবহার সীমিত হয়ে আসতে হবে, কারণ, এর সঙ্গে ঔপনিবেশিক একটা যোগসূত্র আছে। বাধ্যতামূলকভাবে ‘স্যার’ শব্দের ব্যবহার সীমিত করার জন্য তাই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ‘স্যার’ ডাক শোনার প্রত্যাশায় ইতি টানা দরকার। কে কাকে জনাব বলবে, মহোদয় বলবে, মিস্টার কিংবা মিজ বলবে, স্যার না ভাই বলবে, সেটা প্রত্যেক নাগরিকের নিজের উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। জেলা-উপজেলা অফিসে কাজে গিয়ে যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো কর্মকর্তাকে নিজ গরজে শ্রদ্ধা দেখানোর জন্য যদি ‘স্যার’ না বলতে চান, তাহলে ক্ষোভ প্রকাশের কী আছে? অতিরিক্ত ‘স্যারচর্চা’ এক ধরনের অসুস্থতা। এটা কমানো প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে যে, স্যারেরও স্যার আছে। আজ যে স্যার না বলার কারণে রুষ্ট হচ্ছেন, তিনিও তো আরেক স্যারের দ্বারা নাজেহাল হতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পঙ্ক্তিটি মনে রাখা দরকার—
কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
ভাই ব’লে ডাক যদি দেব গলা টিপে।
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা,
কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা।…