বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই মানুষের জন্য রাজনীতি করেনি। তারা রাজনীতিকে কেবল দখলদারি, টেন্ডারবাজি, লুটপাটের প্লাটফর্ম হিসেবেই ব্যবহার করেছে। তাদের কাছে রাজনীতি মানেই যেন এসব! তারা ’৭১-এর পরেও সুস্থ রাজনীতির সুন্দর দেশ দিতে পারেনি, ‘৯০-এর অভ্যুত্থানের পরেও নয়। ’২৪ মহা অভ্যুত্থানের পরেও না পারার দিকেই নিয়ে যাচ্ছে!
’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানকে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো এখনও ‘ক্ষমতার পালাবদল’ হিসেবেই দেখছে। তাই তারা খুব দ্রুতই ভুলে যাচ্ছে আবু সাঈদ, মুগ্ধ, হৃদয়, ওয়াসিমসহ প্রায় দু’হাজার শহীদের কথা। তারা ভুলে যাচ্ছে, এখনও হাসপাতালে কাতরাচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানে মারাত্মকভাবে আহত বহু ছাত্র-জনতা। এতো শহীদ এবং রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে দেশ পূনর্গঠন কিংবা সুস্থ রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ না হয়ে তারা বরং দ্রুতই নির্বাচনের আয়োজন করে ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী! তারা কি চায় এই রাজনীতি জিইয়ে রেখে আরেকটা স্বৈরশাসক তৈরী করতে? যাতে করে আজ থেকে দশ-পনেরো বছর পরে আবারও হাজার হাজার শিক্ষার্থী-জনতাকে বুকের তাজা রক্ত ঝরাতে হবে?
রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষমতায় যেতে চাইবে, সেটা স্বাভাবিক। এটা রাজনৈতিক দলের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কিন্ত ‘২৪ গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী এই সময়টা স্বভাবতই একটা বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজমান।
বদরুদ্দীন ওমর বলেছেন, তিনি এতো তীব্র গণ-অভ্যুত্থান আর দেখেননি! পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম তীব্র ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আর হয়েছে কিনা সন্দেহ। কোনো স্বৈরশাসকের সব এমপি, মন্ত্রী, কর্মীসহ পালাতে হয়েছে; এমন ঘটনা আর কখনো কোথাও ঘটেনি। এসব কি শুধুই ক্ষমতার পালাবদলের জন্য হয়েছে? অবশ্যই না। বরং এই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার এভাবে নেমে আসার পেছনে প্রত্যক্ষ কারণ ছিল কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতার ওপর হাসিনা সরকারের চালানো দমনপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড। কিন্ত, পরোক্ষভাবে যেই জিনিসটা কাজ করেছে তা হলো, আমাদের রুগ্ন রাজনীতি।
বস্তুত, ’৭১-এর পর থেকে যে নোংরা অস্বাস্থ্যকর রাজনীতি আমাদের কুরে কুরে খেয়েছে, তা সাধারণ মানুষকে বিষিয়ে তুলেছিল। ’৯০-এর অভ্যুত্থানের পরে মানুষ গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখলেও রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের মাঝে ক্ষমতার বণ্ঠন না করে তার বিপরীতে ক্ষমতা ভোগ করতে গিয়েই সেই স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে। ফলে তৈরী হয়েছে ভয়ংকর সব স্বৈরশাসক, যারা ক্ষমতায় থাকার জন্য ভোটাধিকার তো হরণ করেছেই, এমনকি জনগণের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়তেও পিছপা হয়নি।
যেই রাজনীতি এহেন বাস্তবতার ভিত্তি তৈরী করতে সাহায্য করেছে, সেই অসুস্থ রাজনীতির প্রতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অথবা নতুন প্রজন্মের যে বিতৃষ্ণা, সেই বিতৃষ্ণাই এই গণ-অভ্যুত্থানের পেছনে পরোক্ষভাবে ‘পুশ ফ্যাক্টর’-এর কাজ করেছে। এই ‘রুগ্ন ক্লিশে’ রাজনীতি দেখতে দেখতে দেশের মানুষ ক্লান্ত। অমিত সম্ভাবনা থাকলেও এই অসুস্থ রাজনীতি তা প্রস্ফুটিত হতে দেয়নি।
আমাদের সময়সাময়িক যেসব দেশ স্বাধীন হয়েছে, তারা তর তর করে এগিয়ে গিয়েছে উন্নত জাতি গঠনে। মালয়েশিয়ার দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যাবে। আর আমরা একই দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছি! এই দুষ্টচক্রের রাজনীতি ভাঙ্গার জন্যইতো ছাত্ররা এতো রক্ত দিল, প্রাণ দিল, হাত-পা-চোখ দিল।
অভ্যুত্থান পরবর্তী ছাত্র-জনতার সবার প্রাণের দাবি, সংস্কারের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হবে না। আর কোনো স্বৈরশাসক তৈরী হবে না। এসব বিষয় ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে।
সুতরাং, একযোগে জাতির কল্যাণে গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে সংস্কার কাজে সরকারকে সময় ও সহযোগিতা দিয়ে সাহায্য না করে, কেন দ্রুত নির্বাচনের জন্য চা দিচ্ছে? তারা কেন গণহত্যার বিচার সবকিছুর আগে করতে হবে, এই দাবী তুলছে না? তারা কেন অভ্যুত্থানে শহীদ ফ্যামিলির দেখভালের আওয়াজ তুলছে না? তারা কেন হাসপাতালে কাতরানো আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার কথা বলছে না? এই বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলো জনকল্যাণমুখী বিশেষ আচরণ কেন করছে না? তারা কি বুঝতে পারছে না যে, মানুষের আকাঙ্খা ঠিক কী? তারা কেন ধরতে পারছে না তারুণ্যের পালস? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে।
যদি মানুষের আকাঙ্খা এবং তরুণ প্রজন্মের পালস রাজনৈতিক দলগুলো বুঝতে না পারে, তাহলে সেটা হবে তাদের ক্ষয়ে যাওয়ার শুরু। আমাদের বুঝতে হবে, রাজনীতিতে আমাদের একটা প্রজন্মগত পরিবর্তনের শুরু হয়েছে। যে তরুণ প্রজন্ম ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান ঘটালো নিজের জিবন বিলিয়ে দিয়ে, তারা অকস্ম্যাৎ আসেনি। ’১৮- এর কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়ে তারা এসে দাঁড়িয়েছে এই গণ-অভ্যুত্থানে। স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে, দেশ সংস্কারের স্লোগান তুলে ‘রেড ফ্ল্যাগ’ টাঙিয়ে দিয়েছে সেই পুরানো বৃদ্ধ-রুগ্ন-ক্লিশে রাজনীতির প্রতি!
’১৮-এর কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং ’২৪-এর মহা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে রাজনীতিবিমুখ এই তরুণ প্রজন্ম আজ প্রচণ্ডভাবে রাজনীতি সচেতন। ইন্টারনেট-প্রযুক্তির কল্যাণে এই তরুণ প্রজন্ম প্রচণ্ডভাবে বিশ্বনাগরিক। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে তারা সারা পৃথিবীর রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছে নিবিড়ভাবে। তারা দেখছে, কীভাবে উন্নত বিশ্বের মানুষ সুস্থ রাজনীতির মজা উপভোগ করছে।
সভ্য বিশ্বের সেই স্বাস্থ্যকর রাজনীতির স্বাদ এই দেশের তরুণ প্রজন্মও পেতে চায়। আমাদের রাজনীতিতে এই যে প্রজন্মগত পরিবর্তন এবং এই প্রজন্মের যে আধুনিক চিন্তা চেতনার স্রোত, তা যদি বয়স্ক রাজনীতিবিদরা বুঝতে না পারে, তাইলে খুব শীঘ্রই তারা বাতিল হয়ে যাবে। তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ দ্রুত গতির এই যুগে তাল মিলাতে না পারলে হারিয়ে যেতে হবে। ফলে যে শূন্যতা তৈরী হবে, তা পূরণ করবে এই বিশ্বনাগরিক আধুনিক তরুণ প্রজন্ম।
আমি মনে করি, ’১৮-এর কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আর ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সেই আধুনিক তরুণ প্রজন্মের নতুন রাজনৈতিক স্রোতের প্রবাহ শুরু হয়ে গিয়েছে। আর এই আন্দোলনগুলোর তরুণ নেতাদের মধ্যে আমরা পেয়েছি আমাদের সেই আধুনিক নতুন রাজনৈতিক স্রোতের নেতৃত্ব। এদের আগমন অবশ্যম্ভাবী। দেশের আকাশে উদিত হয়ে গেছে নতুন রাজনৈতিক সূর্য। আমাদের পুরাতন রাজনৈতিক দলগুলোর হয় তাদের সাথে তাল মিলাতে নিজেদের আধুনিক হতে হবে, না হয় কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে হবে।