গ্রামাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লেখাপড়া। আর সন্ধ্যার পর একজনের পড়া শুনে আরেক জন পাল্লা দিয়ে বই পড়ে না। কোনো মা-বাবা তার সন্তানকে শাসনের সূরে বলেন না যে, অমুক পড়ছে; তুই বসে আছিস চার পাশ থেকে বিভিন্ন স্বরভঙ্গিতে বই পড়ার কেন? অথচ ৫-১০ বছর আগেও সন্ধ্যার পর আওয়াজ ভেসে আসত। পরীক্ষা কাছাকাছি থাকলে তো কথাই নেই।
কোনো সহপাঠী বন্ধু দিনে ও রাতে কতক্ষণ পড়ালেখা করে, তা গোপনে খোঁজ নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু হতো একটা সময়। সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটিও রাতদিন পড়ত। যে কোনো বোর্ড পরীক্ষার আগে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে পড়ার চর্চাটাও আর নেই থেকে উঠে পড়ার চর্চাটাও আর নেই। অথচ এ চর্চাটার জন্যই অ্যালার্ম ঘড়ির আলাদা একটা কদর ছিল।
বোর্ড পরীক্ষার আগে আল-ফাতাহ, পাঞ্জেরী, শিওর সাকসেস, টপ ব্রিলিয়ান্ট সাজেশনসেরও খুব কদর ছিল। আগের বছর পাশ করা ভাইবোনদের কাছে সাজেশনস নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলত। অথচ মাত্র এক যুগের ব্যবধানে সবই প্রায় বিলীন হয়ে গেলেছে। এখনকার দিনে সন্ধ্যার পর দল বেঁধে শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কোথাও কোনো পড়ার শব্দ নেই। গ্রুপ চ্যাটিং, অনলাইন-অফলাইন গেমস, পাবজি, ফ্রি ফায়ার, টিকটক, চুলের বিভিন্ন স্টাইল কার্টিং করে পাড়া-মহল্লায় ও বাজারে আড্ডাবাজি, নিজেদের গ্রুপিং সৃষ্টি করা, শিক্ষাগুরুর সঙ্গে বেয়াদবি করা, শিক্ষককের নামে মিথ্যাচার করা, নিয়ম ভাঙ্গ-এগুলোই এখন যেন তাদের বেশি পছন্দের বিষয়।
গ্রামের পড়াশোনা হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো মাদকের প্রতি ক্রমবর্ধমান আসক্তি। আজকাল ছোট ছোট বাচ্চাও সিগারেটসহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্যে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে নেশার টাকা জোগাড় করতে তারা পড়াশোনা ছেড়ে বিপথগামী হয়ে পড়ছে। অনেকে শিশুশ্রমে নাম লেখাচ্ছে। আর গ্রামে সেভাবে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি বলে তাদের পিতামাতাও সেভাবে সচেতন হননি। ফলে তারা শিশুশ্রমে যুক্ত হলে তাদের পিতামাতাও এক অর্থে খুশি হন। এর কারণ, এতে করে কিছু বাড়তি রোজগার যুক্ত হয় সংসারে।
আর গ্রামের মেয়েরা তো আরো বেশি সমস্যার মধ্যে থাকে। একটু বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এই সংস্কৃতি এখনো দূর হয়নি। ফলে তারা আর লেখাপড়া করার সুযোগ পায় না। গ্রামে এখনো বাল্যবিবাহের চল আছে। প্রশাসনের অগোচরেই হচ্ছে এসব বিয়ে। আর এসব কারণে গ্রামীণসমাজে লেখাপড়া দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে।
গ্রামে লেখাপড়ার পরিবেশ আবারও ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন পিতামাতার সচেতনতা বৃদ্ধি। পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য প্রচারপ্রচারণার পাশাপাশি বিভিন্ন সেমিনার আয়োজন করা যেতে পারে। শিশুশ্রম, শিশুদের কাছে মাদক বিক্রি থেকে শুরু করে বাল্যবিবাহ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। আর পিতামাতার উচিত, বাচ্চাদের মোবাইলে আসক্ত হতে না দেওয়া। ফলে তারা আবারও বই নিয়ে পড়তে বসবে। আবারও শুরু হবে সন্ধ্যায় পড়তে বসার প্রতিযোগিতা। সর্বোপরি, গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থায় সুদিন ফিরে আসবে।