সেকালের পুরোনো নিরাপত্তা বিষয়ক ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্র ও সমাজের সুরক্ষার জন্য নতুন নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও এক্ষেত্রে কেবল পিছিয়ে থেকেছে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি। এমনকি এখনো ঘরের চার দেয়ালের বাইরে প্রতিটি পদক্ষেপে নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা, টেলিভিশন খুললেই দেখতে পাওয়া যায় নারীর প্রতি নানা সহিংসতার ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এসব খবরে সয়লাব থাকে হররোজ। ঘরে-বাইরে, অফিসে-আদালতে, রাস্তায়, গণপরিবহনে, শপিংমলে, রেস্টুরেন্টে—কোনো ক্ষেত্রেই নারীরা নিরাপদ নন! এমনকি নিজের আপনজনের কাছেও নয়। ফলে প্রশ্ন উঠে আসছে, নারীরা নিরাপদ কোথায়? কীভাবে নিশ্চিত হবে নারীর নিরাপত্তা?
বস্তুত, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অবদানও কোনো অংশে কম নয়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। এর মধ্যে সংসারের ভেতর ও বাইরের হিসাব ধরলে তাদের অবদান হবে ৪৮ শতাংশ। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ পোশাক শিল্প থেকে আসে যার ৫৪ শতাংশ কর্মী নারী। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই প্রবাসীদের একটি অংশ নারী কর্মী। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, ১৯৯১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী প্রবাসে কাজ করতে গেছেন। দেশের চা শিল্পের অধিকাংশ কর্মীই নারী।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট কর্মক্ষম নারীদের বেশিরভাগ কৃষিখাতে নিয়োজিত। বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদন, বিপনন, প্রক্রিয়াজাতকরণ—প্রতিটি ধাপে নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে। পশু পালন, মৎস চাষ, হস্ত ও কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন কলকারখানায় নারীরা কাজ করছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিমান চালনাসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশাতেও তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থায় নারীরা কাজ করছেন। আর এর ফলে সচল থাকছে দেশের অর্থনীতি।
বিদেশের মাটিতে গিয়েও ফুটবল, কাবাডি, সাঁতার, ভারোত্তোলনে স্বর্ণ পদক জিতে দেশের নামকে উজ্জ্বল করেছেন নারীরা। এক কথায়, নারীদের অবদান সমাজে ও রাষ্ট্রে কোনো দিক থেকে কম নয়। অথচ তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ আমরা!
‘বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টি চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার করেছে নারী অর্ধেক নর।’ অর্থাৎ নারী পুরুষ উভয়ের মিলিত প্রচেষ্টাতেই তৈরী হয়েছে সব কিছু। সুতারং, নারীকে বাদ দিয়ে একটি দেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। একটি দেশের অর্থনৈতিক চাকা তখনই সচল থাকবে যখন নারী পুরুষ এক সাথে কাজ করবে। আর এ কারণেই পরিবার থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রেই নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তারা যেন নির্ভয়ে কাজ করতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাদেরকে কাজে অনুপ্রাণিত করতে হবে।
নারী নিরাপত্তা রক্ষায় প্রশাসনকে পালন করতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাগুকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি, মানুষের মধ্যে মানবিকতা বোধ জাগ্রত করে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। নারীরাও যেন নির্ভয়ে ও নিসংশয়ে সম্মানের সাথে সমাজে বাঁচতে পারে—প্রত্যাশা এটাই।