চিররঞ্জন সরকার
বাঙালি স্বভাবতই তর্কপ্রিয়। আমাদের বৈশিষ্ট্যই হলো, যে কোনো বিষয়ে তর্কসভা বসিয়ে বিতর্ককে কুতর্কে পরিণত করে বিবাদের মাধ্যমে সমাধান করা। এই ধারা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এটা ঠিক যে, কোনো মত বা ন্যারেটিভ থাকলে তার বিপরীতে অনা ন্যারেটিভও থাকবে। উভয়কে পাশাপাশি স্থান দেওয়াই সুস্থ সমাজবোধ। কোনো একটাকে দাবিয়ে রাখলে সুস্থ সমাজ, সুস্থ গণতন্ত্রের বিকাশ হতে পারে না। কিন্তু আমাদের বর্তমান সমাজে সবাই একতরফা মতামত দিয়ে চলেছেন। তার বিপরীতে যে মত, তার প্রকাশে সর্বতোভাবে কথা সৃষ্টি করছেন। দেশে আজ পক্ষপাতপূর্ণ মতামতই প্রাধান্য পায়। বিরুদ্ধ মতের স্থান নেই। এখন যে কোনো তর্ক ঝগড়া দিয়ে শেষ হয়। বিরুদ্ধ মতপ্রদানকারী শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়।
তর্ক হোক, ঝগড়া নয় —সুস্থ বৃদ্ধির নাগরিকরা ইদানীং দিনের মধ্যে কত বার যে এই কথাটি ভাবতে বাধ্য হন, তার ইয়ত্তা নেই। পথেঘাটে, টেলিভিশনের পর্দায়, সর্বত্র ক্রমাগত তীব্র আবেগে এবং উচ্চ কণ্ঠে কথা কাটাকাটি শুনে কানে তালা লেগে যায়, কারো সঙ্গে মতে না মিললেই গলা ফুলে ওঠে, চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করে, কখনো কখনো আস্তিনও নিজের জায়গায় থাকে না। নানা মুনির নানা মত, এটাই চিরকাল স্বাভাবিক ছিল, আজও তা-ই আছে। মতানৈক্যের ফলে তর্ক হবে, কখনো সেই তর্কের মাত্রা চড়বে, ঝগড়াঝাঁটিও হতে পারে, সেটাও অজানা ছিল না। কিন্তু এখন ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রায়শই যেভাবে উৎকট মূর্তি ধারণ করে, তা কার্যত ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এই রোগ কেবল ঘরে নয়, বাইরেও প্রবল। বিশ্বব্যাপী তার প্রকোপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে, অতিমারি বললে অত্যুক্তি হবে না। কেউ কেউ হয়তো-বা জেনে সুখী হতে পারেন যে, খাস বিলেতেও এই রোগের সংক্রমণ বাড়ছে—সুখ তো প্রায়শই ঈর্ষার উলটো পিঠে বাস করে।
আমাদের দেশে তর্ক বা ঝগড়ার জন্য তেমন কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ লাগে না। তুচ্ছ বিষয় নিয়েও বড় ধরনের ঝগড়া হয়। রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও ঝগড়া প্রকট হয়। মানুষ নিজে যা বিশ্বাস করে, তার বিপরীতে অন্য কিছু সহজে গ্রহণ করতে চায় না। সে সর্বেচ্চ শক্তি দিয়ে তর্ক করার চেষ্টা করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গলা চড়তে থাকে। । তর্ক একপর্যায়ে ঝগড়ায় পরিণত হয় এবং শুরু হয় ব্যক্তিগত আক্রমণ ও গালাগালি। যুক্তির বদলে গলার জোরে জিতে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। সবচেয়ে খারাপ হয় যখন মানুষ সহিংস বা আক্রমণাত্মক হয়ে যায়। চড়থাপ্পড়, হাতাহাতি থেকে চেয়ার ছোড়াছুড়ি, কখনো কখনো মার্ডার। এটাই চারদিকে ঘটে আসছে। যে কোনো রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের সম্পদের যে ভাঙচুর চলে —সেটা একটা বড় উদাহরণ।
অভিভাবকরা আমাদের বলতেন, ‘রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে কখনো এক/দুই টাকা নিয়ে ঝগড়া করবে না। তুমি যদি তাকে মারো অথবা গালি দাও, তার কিছু যাবে-আদবে না। কারণ সে গালি খেয়েই অভ্যস্ত। কিন্তু সে যদি পালটা তোমাকে মেরে বসে অথবা গালি দেয়, তোমার সম্মান শেষ হয়ে যাবে। সম্মান কামাতে বছরের পর বছর চলে যায়, খোয়াতে এক মুহূর্তই যথেষ্ট।’
অনভ্যস্তরা গালির জবাবে পালটা গালি দিয়ে বসলেও কিন্তু সুবিধা করতে পারে না। থাকে গালি দেওয়া হয়, সে কিন্তু থামে না। যেহেতু তার গালাগালির অভিজ্ঞতা বেশি এবং সে নিজের সম্মানের কেয়ার করে না, সে মুখ থেকে মেশিনগান ছুটিয়ে নিজের জাত চেনাবে। আর অনভ্যন্তরা মান্ধাতা আমলের টুটাফুটা খ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে কতক্ষণ লড়বেন? উলটো ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে নিজের রক্তচাপ বাড়াবেন।
বরং এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ভদ্রতার পরিচয় দিয়ে যুক্তি দিয়ে কথা বলাই শ্রেয়। গলা চড়িয়ে গালাগালি করেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে না দেখে নিজেই হতাশ হয়ে যবে। একপর্যায়ে সেও নিজের লিমিট অতিক্রম করে আর না পেরে নিজের চিন্তাকে যাচাই করে নেওয়া এবং নিজের বক্তব্যকে ওছিয়ে নেওয়া। যে কোনো আলেচনার নিজের হার স্বীকার করে নেবে। মহাত্মা গান্ধী এই নীতি অবলম্বন করে ইতিহাস গড়েছেন।
রক্তমাংসের মানুষ হয়েও মহায়া গান্ধী কীভাবে আজীবন অহিংস আন্দোলন চালিয়ে গেছেন?
উত্তর খুবই সহজ, ‘চালাক বুড়োটা’ (তার প্রিয় বন্ধু জিন্নার ভাষায়) সব সময় অহিংস থাকতেন। এতে ইংরেজদের ফ্রাস্ট্রেশন বেড়ে যেত। তাই দেখে তিনি মুচকি মুচকি হাসতেন আর তাদের পিত্তি জ্বালিয়ে দিতেন।
তবে হ্যাঁ, একটা ব্যাপারে ব্রিটিশরা আমাদের তুলনায় কিঞ্চিৎ অগ্রবর্তী। ব্যাধিকে সেখানে ব্যাধি বলে শনাক্ত করা হয়েছে এবং শুরু হয়েছে তার প্রতিকারের উদ্যোগ। গোড়া কেটে আগায় জল ঢালার উদ্যোগ নয়, গোড়া থেকেই নজর দেওয়ার সুচিন্তিত প্রকল্প। ব্রিটেনে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সের ছাত্রছাত্রীদের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ চালাচ্ছেন শিক্ষক ও শিক্ষাবিদরা। তেরো থেকে ছাবিবশ বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা শিখবেন, একে অন্যের সঙ্গে একমত না হয়েও কীভাবে সুস্থ বিতর্ক করা যায়, পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও সম্ভাব বজায় রাখা যায়। উদ্যোক্তাদের আশা, অল্প বয়সে শুরু করলে সুফল মিলবে, নাগরিক সমাজে অসহিষ্ণুতা কমবে আশা পূর্ণ হবে কি না, অভিজ্ঞতাই বলবে। কিন্তু, এই দৃষ্টান্ত অনুসরণযোগ্য, এমনকি অনুকরণেও দোষ নেই। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে ছাত্রছাত্রীদের শেখানো হচ্ছে, কথোপকথন বা তর্কবিতর্কের সময় কারো কথার মধ্যে কথা বলা তো চলবেই না, এমনকি একজনের কথা শেষ হলেই অন্যজন মুখ খুলবেন না, এক মিনিট অপেক্ষা করবেন, তার পরে তিনি নিজের বক্তব্য উচ্চারণ করবেন।
আপাতদৃষ্টিতে অভ্যাসটি সামান্য। কিন্তু তার তন্নিষ্ঠ অনুশীলনে বড় রকমের উপকার হতে পারে। দুটি প্রধান উপকার। এক, অন্যের কথা শুনতে শেখা, সে কথার অর্থ ও যুক্তি অনুধাবন করতে শেখা, তার মূল্য বিচার করতে শেখা। দুই, পক্ষে এই দুই বিদ্যাই যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তা বলে বোঝানোর দরকার নেই। কিন্তু সচরাচর এই অভ্যাসকে সুষ্ঠু কথোপকথন চালানোর জন্য দরকারি সৌজন্য বলেই গণ্য করা হয়। এই অনুশীলন কেবল সৌজন্যের জন্যই আবশ্যক নয়, আত্মোন্নতির পক্ষেও বিশেষ সহায়ক। ভিন্ন মতকে মন দিয়ে শুনে তার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের ধারণাকে নতুন করে বিচার করতে পারলে সেই ধারণাও অনেক বেশি যুক্তিসংগত হয়ে উঠতে পারে। তার মূল্য কেবল কথোপকথন বা সৌজন্যের জন্য নয়, নিজের উত্তরণের জন্যও। বলা বাহুল্য, এই উত্তরণই যথার্থ শিক্ষার লক্ষ্য। প্রশ্ন একটাই। এ দেশে যারা শিক্ষানীতির নির্ধারক এবং যারা সেই নীতি রূপায়ণের অধিকারভোগী, তাদের কাছে যথার্থ শিক্ষার আদৌ কোনো মূল্য কানো মূল্য আছে কি? স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি শিক্ষাকে যে যান্ত্রিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে, তার সঙ্গে প্রকৃত জিজ্ঞাসা, কৌতূহল, পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদির কোনো সংযোগ নেই, বরং অনেকাংশেই বিরুেধ আছে। অন্যের কথা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করলে সেই বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, অন্যকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নিজের কথা জোর গলায় বলে চলাতেই তার ব্যক্তিত্বের প্রমাণ। সুতরাং তর্ক নয়, ঝগড়াই চলুক।
আমাদের অভিজ্ঞতা যে অন্য যে কারো চেয়ে ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে একটি পুরোনো কৌতুক মনে পড়ছে —
শিক্ষক: রকিব, ক্লাসে এত দেরি করে এসেছ কেন?
রকিব: স্যার, বাবা-মা ঝগড়া করছিল। তাই আটকা পড়ে গেলাম।
শিক্ষক: তুমি থামাতে গেলে কেন? স্বামী- স্ত্রীর ঝগড়া এমনিতেই থেমে যায়।
রকিব: সেটা আমিও জানি, স্যার!
শিক্ষক: তাহলে?
রকিব: আমার এক পাটি জুতো বাবার হাতে, আরেকটা মার হাতে ছিল, স্যার…!
লেখক: রম্যরচয়িতা
(এই লেখার সম্পূর্ণ দায় লেখকের। এ সংক্রান্ত বিষয়ে দৈনিক মূলধারা কোনোভাবেই দায়ী নয়)