জুবায়ের হাসান
চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড এক হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক ঘটনা। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শোকাহত হয়ে পড়েছে এ দেশের কোটি কোটি মানুষ। তবে এই শোকাবহ পরিবেশের মধ্যেই আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়ংকর ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। আর এ ফাঁদে পা দেওয়া মাত্রই তা বাংলাদেশের জন্য এক বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। এ ফাঁদ থেকে মুক্ত থাকার সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো আইনের শাসন অনুসরণ। হত্যাকান্ডে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুতই আইনের আওতায় এনে বিচার সম্পন্ন করা।
আমাদেরকে প্রতিবাদ ও দাবি জানাতে হবে, যেন অচিরেই হত্যাকরীর বিচার সম্পন্ন হয়। ঘাতককে শাস্তি দিয়ে যেন ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর পথ রুদ্ধ করা হয়। আমাদের জন্য এই মুহূর্তে ভীষণ জরুরি কাজ হলো, যে কোনো মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষণ করা। কেননা যারা আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অরাজকতা তৈরি করা। গত ৫ আগস্ট ২০২৪-এ হাসিনার পতনের পর থেকেই এমন চক্রান্ত শুরু হয়েছে।
তবে ইতিপূর্বে বাংলাদেশের মানুষ এ ধরনের কয়েকটি চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছে। যেমন, বাংলাদেশের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রায় দেড় মাস আগে এ দেশে শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হতে পেরেছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা। সে সময় উসকানির বিপরীতে এ দেশের মুসলমানরা দিয়েছিলেন হিন্দু ভাইদের মন্দির পাহারা। তাদের ঐ কাজ দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু তাতে চক্রান্তকারীরা থেমে যায়নি। তাই বাংলাদেশের মানুষকে ধারণ করতে হবে যথেষ্ট ধৈর্য। আমাদেরকে ক্রমাগতভাবে মোকাবিলা করে যেতে হবে চক্রান্ত। মুসলমান জনগোষ্ঠী এ দেশের সংখ্যাগুরু। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার দায়িত্ব তাদেরই ওপর সবচেয়ে বেশি। তারাই পরাজিত করতে পারে সাম্প্রদায়িক কূটচাল।
বর্তমান পৃথিবীর বড় এক সমস্যা হাইব্রিড বা পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ। এ যুদ্ধের লক্ষ্য হলো, অপছন্দের দেশকে তার অভ্যন্তরেই পরাজিত করে ফেলা। সাম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টি করে এ লক্ষ্য অতি সহজেই পূরণ করা যায়। এ কাজে ছুড়তে হয় না কোনো গুলি-গোলা বা বোমা- বারুদ। কেননা অপছন্দের দেশের জনগণ নিজেদের সমাজের অভ্যন্তরেই লড়াইরত থাকে। এ হাইব্রিড যুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার হলো তথ্যসন্ত্রাস। সোশ্যাল মিডিয়া বা মূলধারার গণমাধ্যমে বেশুমার ভুল, মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়িয়ে মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়া হয়। এতে সমাজের অভ্যন্তরে চরম সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আর তাতে লাভবান হয় বিপক্ষের বিদেশি দেশ। পরাজিত মাতৃভূমি হারায় তার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বা স্বার্থ।
সম্প্রতি ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যে অনুষ্ঠিত হয় বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি খেলেছিল ‘সাম্প্রদায়িক কার্ড’। বিজেপির নির্বাচনি টিম ঝাড়খণ্ডের মুসলমানদেরকে ক্রমাগত কটাক্ষ করে চলছিল। উদ্দেশ্য ছিল, ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল জনগোষ্ঠীকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে তাদের সব ভোট নিজেদের বাক্সে ভরিয়ে ফেলা। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনে বিজেপি পরাজিত হয়েছে এবং আগের চেয়েও খারাপ ফলাফল করেছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার কয়েকটি উপনির্বাচনেও পরাজিত হয়েছে বিজেপি। তাই বিজেপি তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে খেলতে চাইবে আরো কূটচাল। এতে হাসিনা-পরবর্তী যুগে বাংলাদেশের উঠে দাঁড়ানোর যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তা নষ্ট হবে।
ঠিক এমন একটি সমীকরণের হিসাবনিকাশ থেকেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টির আরেকটি বড় উদ্দেশ্য হলো, পতিত আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন। বাংলাদেশের বর্তমান ডক্টর ইউনুস সরকারকে ব্যর্থ, পরাজিত বা বেকায়দায় ফেলতে পারলে আওয়ামী লীগের ওপর থেকে মানুষের ক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত করা সম্ভব হতে পারে। এমন কুচিন্তা থেকেই সংখ্যালঘুদের ব্যানারে আওয়ামী লীগ ঘটাতে চাইছে অনেক কিছু। এর কতকগুলো বাস্তব দৃষ্টান্ত ইতিমধ্যেই উন্মোচিত হয়েছে। দেশের বিরুদ্ধে এটা এক ভয়ংকর খেলা। তাই বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য আমাদের এ খেলাকে প্রতিহত করতেই হবে। ছিন্ন করতে হবে ষড়যন্ত্রের সব সাম্প্রদায়িকতার জাল।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম এবং তারা ইসলামপ্রিয়; কিন্তু তাই বলে তারা কিছুতেই হিন্দুবিদ্বেষী নয়। বিচ্ছিন্ন কিছু রাজনৈতিক কার্যকারণ ও ঘটনা ছাড়া এ দেশে বরাবরই হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায় পাশাপাশি সৌহার্দপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। এই সৌহার্দমূলক বসবাস যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এটাই এ দেশের ঐতিহ্য।
এ অঞ্চলে ২০০ বছর চলেছে ব্রিটিশদের ভেদনীতির শাসন। এরপর ঘটনাবহুল ১৯৪৭ এবং ঐতিহাসিক ১৯৭১। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশে ঘটেছে কয়েকটি বড় বড় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। এসব ঘটনা ও যাবতীয় প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও এ দেশের সমাজে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সম্পর্ক অটুট থেকেছে।
৫ আগষ্ট ২০২৪-এ হাসিনার ১৫ বছরের নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থার পতনের পর আওয়ামী লীগ স্বাভাবিকভাবেই গণরোষের সম্মুখীন হয়েছে। কতক স্থানে আওয়ামী লীগের কতিপয় নিপীড়ক নেতাকর্মী হয়েছেন লাঞ্ছিত ও আক্রান্ত। এ দেশের মানুষ ও প্রশাসনের চেষ্টায় এ ধরনের ঘটনা বিরাট আকার ধারণ করতে পারেনি বটে। পতিত আওয়ামী লীগের কয়েক লাখ নেতাকর্মীর মধ্যে যে নগণ্যসংখ্যক নেতাকর্মী জনরোধের দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে হিন্দুধর্মের অনুসারীও ছিলেন।
এ ঘটনাকে কোনোভাবেই হিন্দু নির্যাতন বলা যাবে না। কেননা বিষয়টি রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে ঘটেছে। আওয়ামী লীগের মুসলিম নেতাকর্মীরা যেভাবে জনরোষের মুখোমুখি হয়েছেন, সেভাবেই হিন্দু নেতাকর্মীরাও হয়েছেন। তাই এটাকে কে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বলা চলে না, বরং তা রাজনৈতিক প্রতিতিয়ায় সৃষ্ট অস্থিরতা। অথচ হাসিনার পতনের পর থেকেই বেশ কতকগুলো ভারতীয় গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অনবরত সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় কিছু মিডিয়ার এমন মিথ্যা প্রচারণার যথাযথ জবাব দিতে পারে বাংলাদেশের মিডিয়া। এ দেশের গণমাধ্যমের দ্বারাই রক্ষিত হতে পারে আমাদের আদিকাল থেকে গড়ে ওঠা উজ্জ্বল ভাবমূর্তি।
বাংলাদেশের মানুষ বর্তমানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার সবচেয়ে বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। এ পরীক্ষায় আমাদেরকে উত্তীর্ণ হতেই হবে। বাংলাদেশ তো নিজেই পৃথিবীর বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করে যাচ্ছে। বহুসংখ্যক দেশে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের অধীনে কর্মরত রয়েছেন এ দেশেরই সামরিক বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য। এ অর্জনকে আমরা কিছুতেই নষ্ট হতে দিতে পারি না। বরং বাংলাদেশ যেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জন্য আলো দৃষ্টান্ত বা রোল মডেল হতে পারে, সেই চেষ্টায় সবাইকে হতে হবে যত্নবান।
হাসিনা-পরবর্তী যুগে বাংলাদেশ যে যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, তার গতিপথকে ভুল দিকে চালিত করার জন্য দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র বহমান। ইসকনের কথিত সমর্থকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেসবের সুষ্ঠু নিরপেক্ষ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। এ ব্যাপারে জনগণকে আস্থা রাখতে হবে সরকারের ওপর। সহযোগিতা করতে হবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে। নিজ হাতে আইন তুলে নেওয়াটা শুধু বিশৃঙ্খলা-বিভেদ বাড়িয়ে তুলবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, নিজ নিজ ধর্মের নামে যারা অরাজকতা তৈরি করে, তাদের কেউই ধার্মিক নয়, বরং অধার্মিক। ধর্মের নামে যারা নৈরাজ্য ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস করে, তারা নিরেট সন্ত্রাসী, এদের অন্য কোনো পরিচয় নেই। আর সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম থাকে না। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত এক সত্য কথা।
বাংলাদেশের মানুষ সুদূর অতীতকাল থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস রেখে সুখী-সুন্দর-শান্ত সমাজে বসবাস করে আসছে। ভবিষ্যতেও এ দেশের মানুষ তেমন সমাজকেই লালন করে চলবে। সব অশুভ শয়তানি শক্তিকে পরাজিত করে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(এই লেখার সম্পূর্ণ দায় লেখকের। এ সংক্রান্ত বিষয়ে দৈনিক মূলধারা কোনোভাবেই দায়ী নয়)