ইমরান ইমন
মানবসভ্যতাকে বর্তমানে যে কয়েকটি রোগ হুমকির করে তুলেছে, এইডস সেগুলোর মধ্যে একটি। সারা বিশ্বেই এখন এই রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে এবং ভয়াবহ হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রোগের আইরাস শরীরে প্রবেশ করলে মানবদেহের জভাবিক রোগপ্রতিরোধক্ষমতা নাই হয়ে যায়। তখন যে কোনো সংক্রামক জীবাণু সহজেই এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে পারে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর ১ ডিসেম্বরা বিশ্ব এইডস দিবস। বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে দেশে দেশে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। উদ্দেশ্য এই রোগ সম্পর্কে জানা এবং এর প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পৃথিবীতে প্রায় ৪ কোটি মানুষ শরীরে এইডসের জীবাণু বহন করে চলেছে এবং একে সঙ্গে নিয়েই বেঁচে আছে, কিন্তু তার মধ্যে প্রায় ১ কোটি লোকের কোনো ধারণাই নেই যে, তাদের শরীরে এই ঘাতক ভাইরাসটি রয়েছে।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হলো- Take the rights path: My health, my right।’ অর্থাৎ, সঠিক পথ বেছে নিই। আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার।’
এইডসের পুরো নাম হচ্ছে একোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েনসি সিনড্রম। এই ভাইরাসের সংক্ষিপ্ত নাম এইচআইডি। বিশ্ব জুড়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে এখনের এ রোগের প্রতিষেধক বা চিকিৎসাব্যবস্থা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি। যন্ত্রণাদায়ক অকালমৃত্যুই হচ্ছে এ খাতক রোগে আক্রান্তদের শেষ পরিণতি। প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে বিশ্ববাসী এ রোগ নিয়ে মুশ্চিন্তা ও আতষ্কপ্রান্ত (কারো শরীরে এইচআইভি আছে কি না, তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
শুধু রক্ত পরীক্ষা করে এ ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এইডসের ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ হওয়ার কত বছর পর এইডস হবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। কায়েক মাস বা ১০-১৫ বছরের মধ্যে এই রোগ দেখা দিতে পারে। তবে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এইচআইভি মাক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৭৫ জনের ১০ বছরের মধ্যেই এইডস হয়েছে।
এই নীরব ঘাতকের জন্ম কোথায়, কীভাবে, তা নিয়ে এখনো বিজ্ঞানীদের মধ্যে চলছে বিতর্ক। তবে গবেষণা করে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্তে আসা গেছে যে, পঞ্চাশের দশকে আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্র কৃষক শ্রেণির মধ্যে প্রথম এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এরপর যাট ও সত্তরের দশকে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও কিছু কিছু এইডসের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে। কোনো কোনো গবেষকের মতে মধ্য আফ্রিকার এক প্রকারের সবুজ বানরের দেহে প্রথম এইডস বা এইচআইভি ভাইরাসের উপস্থিতি দেখা যায়।
১৯৮০ সালে প্রথম এ মাতক রোগটি শনাক্ত করা হয়। ১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু নিউমোনিয়ার রোগী পাওয়া যায়, যার কারণ নিউমোসিস্টিস ক্যারিনিয়াই নামক একটি জীবাণু, যার বর্তমান নাম নিউমোসিস্টিস জিপ্লেতেসি। পরে আফ্রিকায় প্রাদুর্ভাব ঘটে ঝাপোসিস সারকোমা নামক একটি টিউমারের। এ টিউমার থেকেই রোগটি শনাক্ত করা হ্যা। এইডসের উৎপত্তিভূমি চিহ্নিত করার দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯২০-এর দশকে কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসায় (তৎকালীন লিওপোন্ডভিল) অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচারের ফল হিসেবে এইডসের সৃষ্টি হয় বলে নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
দেশ ও স্থানভেদে এইডসের লক্ষণের পার্থক্য দেখা যায়। এইডসের কিছু সাধারণ লক্ষণ- অনেকদিন বা বারবার জ্বর হয় কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, অতিরিক অবসাদ, শরীরের ওজন দ্রুত হ্রাস পাওয়া, লিক্ষশ্রন্থি ফুলে ওঠা, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাড়ের জয়েন্টগুলো ফুলে থাকা যন ঘন বিভিয় রোগে আক্রান্ত হওয়া, যেমন- যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, প্রস্রাবের প্রদাহ। এছাড়া দীর্ঘদিন ডায়রিয়ার সমস্যা, যা স্বাভাবিক চিকিৎসায় কোনোক্রমেই ভালো হয় না, দৃষ্টিপতির প্রখরতা কমে যাওয়া, তীব্র মাথাব্যথা ইত্যাদি। তবে কারো মধ্যে এসব লক্ষণ দেখা দিলেই তার এইডস হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ছাড়িয়ে মহাদেশেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে প্রথম এইডস আক্রন্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। প্রথম যিনি শনাক্ত হয়েছিলেন, তিনি এখনো সুস্থভাবে বেঁচে রয়েছেন। তিনি নিয়মিতভাবে এইচআইভি চিকিৎসা কর্মসূচির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। জাতিসংঘের এইচআইভি-এইডস-বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইডসের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এইডস আক্রান্তের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ০১ শতাংশ। ইউএনএইডসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এইডস আক্রান্ত ব্যাক্তির সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। তবে দেশে চিকিৎসার আওতায় রয়েছে মাত্র ৮ হাজার রোগী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল (এনএএসসি) প্রোগ্রামের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত বছর নতুনভাবে এইচআইভি সংক্রমিত ৭২৯ জনের মধ্যে পুরুষ ৪২০ জন, নারী ২১০ ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ১২ জন। দেশের ২৩টি জেলায় এইচআইভি রোগী বেশি শনাক্ত হওয়ায় সেসব এলাকাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে সরকার।
বর্তমানে দেশের ২৮টি পরীক্ষাকেন্দ্রে ১১টি সেবা সেন্টারে এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তিদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। যার মধ্যে চারটি সরকারি হাসপাতাল থেকে এইডস আক্রান্ত রোগীদের বিনা মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে মাসে এক জন এইডস রোগীর পেছনে সরকারের খরচ ২০-২৫ হাজার টাকা।
মরণব্যাধি এইডস থেকে বাঁচতে হলে সবার, বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এইডস প্রতিরোধে গণসচেতনতাই এখন মুখ্য বিষয়। তাই এইডস প্রতিরোধে প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং কার্যকর পদক্ষেপ।