দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা বর্তমানে বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ভবিষ্যতে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি সংগ্রহ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য পুঁজি সংগ্রহের জন্য স্টক মার্কেটকে উপজীব্য করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি সংগ্রহ করা হলে মিসম্যাচ হওয়ার আশঙ্কা থাকে, কিন্তু স্টক মার্কেট থেকে পুঁজি সংগ্রহ করা হলে সে ধরনের কোনো আশঙ্কা থাকে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর থেকে বড় ধরনের ২৪টি দুর্নীতির মাধ্যমে ৯৩ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে একটি বিশেষ মহল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এটা খেলাপি ঋণের প্রদর্শিত পরিমাণ মাত্র। ২০০৯ সালে ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিগত সরকার আমলে দেশের ‘অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড’ হিসেবে খ্যাত ব্যাংকিং খাত এবং রাজস্ব খাতকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তার এই মন্তব্য আক্ষরিক অর্থেই ঠিক। বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরের মোট খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কোনো কোনো ব্যাংক আমানতকারীদের চাহিদামতো অর্থ উত্তোলন করতে পারছে না। এই অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় তারল্য জোগান দিচ্ছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক মোট ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জোগান দিয়েছে। এই অর্থ টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের পর টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করার বিপক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করেছিলেন।
এই অবস্থায় বলা যেতে পারে যে, ভবিষ্যতে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ জোগান দিতে পারবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে গতিতে বিকশিত হচ্ছে তাতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হওয়া উচিত। কিন্তু অনেক দিন ধরেই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশে ওঠানামা করছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত থাকলেও তা অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত আছে, যা অর্জিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এছাড়া দেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশের অভাব রয়েছে। জাপানি একটি সংস্থা তাদের গবেষণায় উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে যেসব জাপানি উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট নন। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। এই প্রতিবেদনে ৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ বিবেচনায় চতুর্থ ক্যাটাগারিতে স্থান দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকিং সেক্টর বিনিয়োগকারীদের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সাপোর্ট দিতে পারছে না। বিশেষ করে বেশির ভাগ ব্যাংকই বিনিয়োগযোগ্য তারল্য সংকটে ভুগছে। ভবিষ্যতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের চাহিদা নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ব্যাংকিং সেক্টর সেই চাহিদা পূরণে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। কারণ ব্যাংকগুলো যদি বিনিয়োজিত অর্থ আদায় করতে না পারে, তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে তারল্য সংকট মেটানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
বিনিয়োগযোগ্য তহবিল সমস্যা মেটানোর জন্য স্টক মার্কেটকে ভিত্তি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হলেও স্টক মার্কেটকে এমনভাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে বিনিয়োগকারীরা তাদের দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন চাহিদা এখান থেকে মেটাতে পারেন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে উদ্যোক্তাগণ সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভর না করে স্টক মার্কেট থেকে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করে থাকেন।
স্টক মার্কেট থেকে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল আহরণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যায়, যা ব্যাংকের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়। ব্যাংক নির্দিষ্ট কিছু শর্তের বিনিময়ে একজন উদ্যোক্তাকে ঋণ প্রদান করে থাকে। ইন্টারেস্ট ডিউরিং কনস্ট্রাকশন পিরিয়ড (আইডিসিপি) বলে একটি সিস্টেম চালু আছে। ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন কোনো প্রকল্পের নির্মাণকাল ধরা হয় ছয় মাস। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের অধিকাংশ প্রকল্পই ছয় মাসের মধ্যে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে পারে না। একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই উদ্যোক্তাদের হয়রানি করা হয়। ফলে একটি প্রকল্প অনুমোদনের পর থেকে বাস্তবায়ন সম্পন্ন করতে দেড় থেকে দুই বছর পর্যন্ত লেগে যায়। প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক কিন্তু বসে থাকবে না। নির্মাণকালে ব্যাংক সামান্য পরিমাণ সুদারোপ করে থাকে। কিন্তু ছয় মাস অতিক্রান্ত হলে ব্যাংক তার দেওয়া ঋণের ওপর পূর্ণ মাত্রায় সুদ আরোপ করতে থাকে। ব্যাংকঋণ দেবে সেই ঋণ ব্যবহার করে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলো কি না, তা দেখার দায়ভার ব্যাংকের নয়। পা বেঁধে কাউকে দৌড় প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিলে যে অবস্থা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে উদ্যোক্তাদের অবস্থা হয় ঠিক তেমনি। অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণে উত্পাদিত পণ্যের বাজারচাহিদা কমে যায়, অথবা বিদেশি কোনো ব্র্যান্ডের পণ্য এসে বাজার দখল করে ফেলে।
কিন্তু একজন উদ্যোক্তা যদি স্টক মার্কেট থেকে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল আহরণ করেন, তাহলে তাকে এসব সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে না। কারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা যে কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করবেন, সেই কোম্পানি উত্পাদনে যাওয়ার পর লাভজনকতা অর্জনের পরই শুধু শেয়ার হোল্ডারদের ডিভিডেন্ড প্রদানের প্রশ্ন আসবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হলে অথবা লাভজনকতা অর্জনের আগ পর্যন্ত প্রকল্প মালিক শেয়ার হোল্ডারদের ডিভিডেন্ড প্রদানে বাধ্য নয়। শেয়ার ব্যবসায় ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অত্যন্ত লাভজনক একটি বিনিয়োগ ক্ষেত্র। যারা ক্ষুদ্র পুঁজির মালিক, তারা বিদ্যমান বাস্তবতায় সাধারণত বিনিয়োগকারী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন না। কিন্তু তারা যদি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগের সুযোগ পান, তাহলে ভবিষ্যতে বড় বিনিয়োগকারী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার রাস্তা উন্মুক্ত হয়। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। এদের বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র হতে পারে স্টক মার্কেট।
বাংলাদেশের স্টক মার্কেট বিকশিত হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বাজারের ওপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব। ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে দেশের স্টক মার্কেটে যে ভয়াবহ দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারীর ঘটনা ঘটে, তার কোনো বিচার আজো পর্যন্ত হয়নি। স্টক মার্কেটে বিনিয়োগের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেই অনেকের স্মৃতিপটে সেই দুঃসহ ঘটনা জাগ্রত হয়।
দেশের স্টক মার্কেটে ভালো মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ারের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। দেশের বড় বড় কোম্পানির মধ্যে অধিকাংশই এখনো স্টক মার্কেটের বাইরে রয়ে গেছে। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে অনেক উদ্যোক্তা তাদের কোম্পানিকে শেয়ার বাজারে আনতে চান না। এছাড়া মনে করা হয়, শেয়ার বাজারে নিবন্ধিত হলে নানা ধরনের জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হবে। কোনো কোম্পানি স্টক মার্কেটে নিবন্ধিত হলে কর হ্রাস সুবিধা প্রদান করা হয়। কিন্তু তারপরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভালো কোম্পানি স্টক মার্কেটে নিবন্ধিত হচ্ছে না। প্রকল্প নিবন্ধনের সময় এমন শর্তারোপ করা যেতে পারে যে, কোম্পানিটি উৎপাদন শুরু করার আগেই নির্দিষ্টসংখ্যক শেয়ার বাজারে ছাড়তে হবে, অর্থাত্ ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার বাধ্যতামূলকভাবে বাজারে ছাড়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার বাজারে ছাড়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করার উদ্যোগ নিতে হবে। গত সরকার আমলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ২৬টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল বাজারে শেয়ার ছাড়ার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ট্রেজারি ব্যাংক হিসেবে সোনালী ব্যাংক পিএলসিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রেখে অবশিষ্ট সব রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক পর্যায়ক্রমে শেয়ার ছাড়ার মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী এবং কর্মকর্তাগণ ইচ্ছে করলে শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় যুক্ত হতে পারবেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে ছাড়া হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি বৃদ্ধি পাবে।
লেখক : সাবেক পরিচালক, বিএসটিআই ও বিশিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তা
অনুলিখন : এম এ খালেক