ক্ষমতার রাজনীতি এবং শাসনের কূটকৌশল চিরকালই মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। এ ধারণার অন্যতম পুরোধা, তথা প্রবাদপ্রতিম চিন্তাবিদ হলেন নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। তাঁর অমর গ্রন্থ ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে তিনি শাসন এবং ক্ষমতার প্রয়োগের যে বাস্তবতাবাদী ধারণা তুলে ধরেছেন, তা আজও আধুনিক রাজনীতি এবং ক্ষমতার ক্ষেত্রগুলিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।
বলা বাহুল্য, রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবে ম্যাকিয়াভেলি বিশ্বাস করতেন, রাজনীতিতে নৈতিকতার চেয়ে বাস্তবতা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, ক্ষমতা অর্জন বা তা ধরে রাখার জন্য শাসকের যে-কোনো উপায় অবলম্বন বৈধ। এই দর্শনের ভিত্তিতেই জন্ম নিয়েছে ‘ম্যাকিয়াভেলিয়ানিজম’, যা কূটকৌশল, নৈতিকতা-বিবর্জিত ক্ষমতার প্রয়োগ এবং স্বার্থান্ধতার প্রতীক।
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭), ইতালির রেনেসাঁ যুগের প্রভাবশালী রাজনীতিক, দার্শনিক এবং লেখক। তাঁর দ্য প্রিন্স বইটি তরুণ রাজপুত্রের জন্য পরামর্শমূলক হলেও এতে রাজনীতি ও ক্ষমতার বাস্তবধর্মী, নৈতিকতাবর্জিত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। বইটির প্রসিদ্ধ উক্তি, “শাসকের প্রতি জনগণের ভালবাসা এবং জনগণের ভয় দুটোই থাকতে হবে। যদি দুটোই না থাকে সেক্ষেত্রে ভয়টি অন্তত থাকতে হবে।” শাসকদের উদ্দেশ্যে ম্যাকিয়াভেলির সুস্পষ্ট পরামর্শ— প্রজারা ভালোবাসার বদলে ভয় পেলে শাসকের প্রতি বেশি অনুগত থাকবে।
তাঁর আরেক বিখ্যাত বক্তব্য, “রাজনীতি মানেই হলো ক্ষমতা ‘গ্রহণ আর প্রয়োগের’ নীতি”, যা ম্যাকিয়াভেলি দর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দু। ম্যাকিয়াভেলির মতে, শাসকের জন্য নৈতিকতার সংজ্ঞা অর্থহীন; ক্ষমতা ধরে রাখা এবং বাড়ানোর প্রয়াসে যে-কোনো কার্যকর উপায় গ্রহণযোগ্য। শাসকের প্রথম ও প্রধান গুরুদায়িত্ব হলো ক্ষমতা ধরে রাখা, আর এজন্য প্রয়োজন বাস্তববাদিতা।
তদুপরি, তিনি দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেন, ক্ষমতার রাজনীতিতে শাসকের সদাশয়তা সবসময় কার্যকর নাও হতে পারে। এর চেয়ে কৌশলী ও প্রয়োজনে কঠোর হওয়া অধিক কার্যকর। তিনি বলেন, “যেহেতু উত্তম অস্ত্র ছাড়া উত্তম আইন প্রতিষ্ঠিত হয় না, তাই অস্ত্র ছাড়া অন্য কোন কিছুকেই আমি বিবেচনায় আনবো না”, এই বক্তব্য শাসকদের মানব প্রকৃতির দুর্বলতাকে কৌশলে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেয়।
একথা অনস্বীকার্য, ইতিহাসে বিভিন্ন শাসক ম্যাকিয়াভেলির নীতিকে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করেছেন। কেউ কেউ সেই নীতির সর্বোপরি প্রয়োগে সফলও হয়েছেন, কেউ আবার নিন্দিত হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ:
এক. নিকোলাস মাদুরো (ভেনিজুয়েলা): তিনি গণতন্ত্রের ছায়া বজায় রেখেও নেপথ্যে জনতার উপর কৌশলগত দমন-পীড়ন এবং সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন।
দুই. জোসেফ স্ট্যালিন: তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা স্ট্যালিনের শাসনকাল ছিল এক চমৎকার ম্যাকিয়াভেলিয়ান কৌশলের উদাহরণ। তিনি তার প্রতিপক্ষদের নির্মমভাবে দমন করেন এবং শাসনের সর্বোচ্চ স্থানে নিজের ক্ষমতা নিশ্চিত করেন। স্ট্যালিনের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা যায়, “একজন শাসককে বাহ্যিকভাবে নীতিবান হিসেবে দেখাতে হবে, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে কাজ করতে হবে।”
তিন. অ্যাডলফ হিটলার (জার্মানি): হিটলারের শাসনে ম্যাকিয়াভেলিয়ান কৌশল স্পষ্ট। উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে জার্মান জনগণের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর কৌশল ম্যাকিয়াভেলির সেই কথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়: “একজন শাসকের বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করার প্রথম পদ্ধতি হলো, তার চারপাশে থাকা ব্যক্তিদের দিকে নজর দেওয়া।”
চার. রিচার্ড নিক্সন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র): যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়াস এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র স্পষ্টভাবে ম্যাকিয়াভেলি-প্রভাবিত বলে মনে করা হয়।
তদ্ব্যতীত, সমসাময়িক বিশ্বেও রাষ্ট্র দখল বা নব্য সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারে ম্যাকিয়াভেলিজমের প্রয়োগ লক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ, চীনের ‘ঋণের ফাঁদ’ কৌশলকে অনেকেই ম্যাকিয়াভেলিয়ান কৌশল বলে অভিহিত করেন, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনার একটি কার্যকর পদ্ধতি।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর রাজনীতিতেও ম্যাকিয়াভেলিয়ান কৌশল একেবারে নতুন কিছু নয়। নির্বাচনের আগে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনমত প্রভাবিত করা, প্রতিপক্ষকে নিঃশেষ করতে আইনি কাঠামোর ব্যবহার, কিংবা ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগানোর মতো কর্মকাণ্ড এ দেশের রাজনীতিতে হরহামেশা দেখা যায়।
যাহোক, নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি একদিকে রাজনীতির কঠোর বাস্তবতা তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে নৈতিকতার প্রশ্নে বিতর্ক উসকে দিয়েছেন। উইনস্টন চার্চিল যেমন তাঁকে সম্মান জানিয়েছেন, তেমনি মহাত্মা গান্ধীর মতো আদর্শবাদীরা তাঁর নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। গান্ধী বলেছিলেন, “চোখের বদলে চোখ কেড়ে নিলে পুরো পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে।”
পরিশেষে বলা যায়, ক্ষমতার মানসপটে ম্যাকিয়াভেলিয়ানিজম এমন এক দর্শন, যা মানুষের প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি এবং রাজনীতির বাস্তবতার মধ্যে সংযোগ ঘটায়। যদিও এটি নৈতিকতার দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ, তবে শাসন ও কূটনীতির ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা অনস্বীকার্য। বর্তমান বিশ্বে যেখানে নৈতিকতা এবং বাস্তবতাবাদ প্রায়শই পরস্পরের বিপরীতমুখী, সেখানে ম্যাকিয়াভেলি আমাদের সামনে এমন এক প্রশ্ন রাখেন, যা চিরকালই মানবজাতির চিরন্তন আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে। প্রশ্ন: শাসকের জন্য নৈতিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত, নাকি ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চবি শাখা।