বর্তমান সময়ে নারী অধিকারের কথা বলা হলেও আমাদের সমাজে নারীরা পারিবারিকভাবে বিভিন্ন অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার। নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে পারিবারিক সহিংসতায় গৃহ-নির্যাতন একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নারী নির্যাতন বৈশ্বিক সমস্যা। তবে বাংলাদেশে পারিবারিক গৃহ-নির্যাতন একটি দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক সমস্যা। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া একজন নারীর ন্যায়বিচার ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, যা সমাজের জন্য লজ্জাজনক এবং নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় বৈষম্য সৃষ্টি করে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ নারী তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময় গৃহ-নির্যাতনের শিকার হন। এই প্রেক্ষাপটে আমরা গত ২০ অক্টোবর পত্রিকায় প্রকাশিত ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ১৩ বছর বয়সি কল্পনার কথা বলতে পারি। যে সাড়ে চার বছর ধরে একটি বাসায় কাজ করত, কিন্তু দিনশেষে নির্যাতনের শিকার হয়ে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। তার ওপর নির্যাতনের চিহ্ন—সামনের চারটি দাঁত ভাঙা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছঁ্যাকা দেওয়ার ক্ষত, বুক, পিঠসহ সারা শরীরে আঘাতের দাগ। এছাড়া মানসিক ট্রমা তো আছেই। স্বভাবতই প্রশ্ন, কোথায় নিরাপদ নারী?
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের ছোট করে দেখা নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ। আমাদের সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নারীদের অধিকার ও মর্যাদাকে দমিয়ে রাখে। এছাড়া পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব ও দারিদ্র্য নারীদের তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়কে মেনে নিতে বাধ্য করে।
আমাদের দেশে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে রয়েছে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা। প্রয়োজনীয় আইন থাকা সত্ত্বেও তার যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে অপরাধীরা আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিচারের শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যায়। যার ফলে নারী নির্যাতন হতেই থাকে। এছাড়া নারী নির্যাতনের পেছনে আরো একটি অন্যতম কারণ হলো সামাজিক চাপ ও নারীদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার ভয়। যার ফলস্বরূপ অনেক নারী সামাজিক অপবাদ ও পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে নির্যাতনের কথা গোপন রাখতে বাধ্য হয়। যা দিনের পর দিন একজন নির্যাতিত নারীর মধ্যে মানসিক চাপ বাড়াতে থাকে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পারিবারিক সহিংসতার অন্যতম কারণ হলো যৌতুক। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ২০২১-এর তথ্য অনুযায়ী, নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যৌতুকের শিকার। যৌতুকের কারণে নারীর গৃহ-নির্যাতনের শিকার হওয়ার পাশাপাশি ঘটছে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা। যা শুধু সেই নারীর জীবনে নয়, বরং পরবর্তী প্রজন্মের জীবনেও ফেলছে মারাত্মক প্রভাব।
নারীর প্রতি সহিংসতার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এই নির্যাতন শারীরিক আঘাতকে ছাড়িয়ে, মানসিকভাবেও একজন নারীকে অস্তিত্বহীন করে তোলে। যা একজন নির্যাতিত নারীর স্বাভাবিক জীবনযাপনকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। অনেকে মানসিক চাপ সহ্য করতে না পারার কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
পারিবারিক সহিংসতায় নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পরিবারের পাশাপাশি সমাজের প্রত্যেক সদস্যকে সচেতন হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলার মানসিকতাও। নারীকে অবহেলার চোখে না দেখে বা দুর্বল না ভেবে, বরং পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। যেখানে আইনের সহায়তা প্রয়োজন, সেখানেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য কর্মসংস্থান ও শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
গৃহ-নির্যাতনের শিকার নারীরা আমাদের সমাজের নিপীড়িত অংশ। এই সমস্যার সমাধান কেবল আইন বা প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্ভব নয়, বরং আমাদের মনোভাব ও পারিবারিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিটি নারীকে তার অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে, আমরা সত্যিকার অর্থে তখনই একটি সভ্য ও মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারব।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, রাজশাহী কলেজ