প্রতিটি শিশু তার পরিবার, আত্মীয়স্বজনের দ্বারা লালিত-পালিত হয়ে বেড়ে ওঠে। যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে শিশু জন্মগ্রহণ করে এবং লালিত-পালিত হয়, সেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ তার ব্যক্তিত্বের গঠন ও বিকাশে প্রভাব রাখে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত—রসুল (স.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক সন্তানই ‘ফিতরত’-এর ওপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার মাতাপিতা নিজেদের সংস্রব দ্বারা তাকে ইহুদি করে দেয় বা নাসরানি করে দেয় অথবা অগ্নি-উপাসক করে দেয় (বোখারি মুসলিম)।’
উল্লিখিত হাদিসে ‘ফিতরত’-এর ব্যাখ্যায় হাদিস বিশেষজ্ঞগণ লিখেছেন, প্রত্যেক শিশুই জন্মগতভাবে ইসলাম কবুলের যোগ্যতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কিন্তু পরিবেশ, বিশেষত তার মাতাপিতা তার সেই যোগ্যতাকে প্রকাশ হতে দেয় না, তাই সে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হয়ে যায়। যদি পরিবেশ অনুকূলে থাকত, তবে তার সেই জন্মগত যোগ্যতা প্রকাশিত হয়ে সে মুসলমান হয়ে যেত।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা ব্যক্তিত্বের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা বিশ্লেষণ করে প্রফেসর মো. আমির হোসেন মিয়া ও এ কে এম শওকত আলী খান রচিত ‘প্রারম্ভিক নৃবিজ্ঞান’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ব্যক্তি তার জন্মলগ্নে অনন্ত সম্ভাবনা এবং বিচিত্র শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আসে। জন্মের পর থেকেই পরিবেশের বিভিন্ন শক্তি ব্যক্তির ওপর ক্রিয়া করে এবং এর ফলে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত শক্তি, সহজাত প্রবৃত্তি ও প্রবণতা এবং পরিবেশের শক্তির মধ্যে যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়, তা থেকে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশ লাভ করে। পৃথিবীতে রয়েছে নানা গোত্র, বর্ণের মানুষ। প্রত্যেকটি জাতি, গোষ্ঠী ও জনপদের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। প্রত্যেকের ভৌগোলিক পরিবেশ এবং জাতিগত উত্তরাধিকার অভিন্ন। তবুও তাদের ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যে যেসব পার্থক্য লক্ষ করা যায়, তা নিশ্চয়ই পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফল।
সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক ভিন্নতার কারণে মানুষের মুখের ভাষা, আচার-ব্যবহার, দেহের রং, সংস্কৃতি, আকার-আকৃতি প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। সমাজের নিয়ম অনুযায়ী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিক্ষিত পরিবারের সন্তানেরা শিক্ষিত হয়। ধার্মিক পরিবারের সন্তানেরা ধার্মিক হয়। মুসলমান পরিবারের সন্তানেরা মুসলমান হয়। হিন্দু পরিবারের সন্তানেরা হিন্দু হয়। কদাচিত্ এক-দুইটা ব্যতিক্রম হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে যিনি ব্যতিক্রম ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়েছেন, তার ব্যাপারে অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, তিনি অন্য কোনো সমাজের সংস্পর্শে এসে নিজেকে ভিন্নভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন।
ধর্মীয় কিতাবাদি অধ্যয়ন বা কোনো ধার্মিক মানুষের সংস্পর্শে এসে মানুষ ব্যক্তিত্ববান ধর্মপরায়ণ হয়ে যায়। আবার অপরাধ পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তিত্বহীন মানুষের সংস্পর্শে এসে অনেকেই ব্যক্তিত্ব হারায়। ধর্মকর্ম ভুলে যায়। সবার জানা একটি প্রবাদ হচ্ছে—‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। অর্থাত্, ব্যক্তি যাদের সঙ্গে সর্বদা চলাফেরা করে, কথাবার্তা বলে, তারা যদি সত্, নৈতিক, ধার্মিক, উন্নত ব্যক্তিত্ববান হন, তাহলে সেও উন্নত ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবে।
কোনো ব্যক্তির কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার, চালচলন, মেজাজ-মর্জি, প্রকাশভঙ্গি প্রভৃতি যদি আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে মনের মধ্যে রেখাপাত করে, তাহলে তার সম্পর্কে আমরা বলি—লোকটির ব্যক্তিত্ব আছে। ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে কতিপয় বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রফেসর মিয়া ও খান ‘প্রারম্ভিক নৃবিজ্ঞানে’ উল্লেখ করেছেন, আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা ব্যক্তিত্ব বলতে ব্যক্তির গুণাবলি বা বৈশিষ্ট্যের সমন্বিত রূপকে বুঝিয়ে থাকেন। মূলত, ব্যক্তিত্ব হলো ব্যক্তির সব বৈশিষ্ট্যের সুসামঞ্জস্য ধারা, যা তার আচরণে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।
সামাজিক জীব হিসেবে ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের উত্স প্রধানত দুটি। একটি হলো জন্মগত এবং অন্যটি হলো সমাজ ও সংস্কৃতিগত। ব্যক্তি মানুষের সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন হয় তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জৈব বৈশিষ্ট্য এবং সমাজ-সংস্কৃতির উপাদানসমূহের সংযুক্তির ফলে। ব্যক্তি মানুষের মনোভাব, মূল্যবোধ, চিন্তাচেতনা, আচার-আচরণ সংক্ষেপে তার সমগ্র ব্যক্তিত্ব নির্ধারিত হয় সমাজ-সংস্কৃতির দ্বারা, অর্থাত্ সমাজ-সংস্কৃতির ওপর মানুষের ব্যক্তিত্ব নির্ভরশীল।
সামাজিক পরিবেশের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য হলো গৃহ বা পরিবারের পরিবেশ। পরিবারের পিতামাতা, ভাইবোন ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের কার্যকলাপ, চিন্তাধারা ও আদর্শ শিশুর ব্যক্তিত্বের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুর পিতামাতা যদি শিশুকে স্বাধীনভাবে কথা বলার এবং কাজ করার সুযোগ দেন, তবে শিশুর মধ্যে আত্মনির্ভরতা, আত্মবিশ্বাস, সাহস, স্বাধীনভাবে কর্ম ও চিন্তা করার ক্ষমতা দেখা দেয়। এর ফলে শিশু স্থির ব্যক্তিত্ব অর্জন করে। পক্ষান্তরে যদি শিশুর পিতামাতা শিশুর প্রতি নির্মম ব্যবহার করেন, তাহলে শিশু বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন, অসংযত, ভীরু, অসামাজিক ও রুক্ষ মেজাজের হয়ে থাকে। প্রত্যেক শিশুকেই পিতামাতা ও পরিবার-পরিজন যেভাবে গড়ে তুলবেন, ঠিক সেভাবেই সে গড়ে উঠবে।
শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠন ও বিকাশের মূলে পরিবার ও বিদ্যালয়ের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পাড়া-প্রতিবেশীর আচার-আচরণের দ্বারাও ব্যক্তিত্ব প্রভাবিত হয়। কাজেই প্রত্যেকটি শিশুকে নৈতিক, ধার্মিক ও আদর্শিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে ব্যক্তিত্ববান সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে পরিবার, বিদ্যালয় ও আশপাশে সেই উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সভাপতি, ইসলামী তরুণ সংঘ, শাহপরাণ (রহ.) সিলেট