মাতৃভূমির মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি। স্বাধীন দেশে লাল-সবুজের পতাকাতলে বসবাস করছি। ওপরে তাকালে আকাশ দেখি, নিশ্বাসে বুকের ভেতর টেনে নিই বাতাস। এই লাল-সবুজের পতাকাটির জন্য এ দেশের নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা লড়াই করে ছিনিয়ে আনে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হয়। মুক্তির স্বাদ পায় দুর্মর বাঙালি জাতি। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে চিরঋণী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধপূর্ব প্রেক্ষাপট ও ঘটনাপ্রবাহের সংগ্রাম পরিণতি অর্জন করেছে কয়েকটি ধাপে; যার প্রতিটি ধাপে রয়েছে এ দেশের নারীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও আত্মত্যাগ।
মুক্তিযোদ্ধা বললেই যে চিত্রটা সামনে আসে তা হলো, আর্মস নিয়ে যুদ্ধ করা। এই যুদ্ধ ছিল সর্বস্তরের জনগণের। তখন এ ভূখণ্ডের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। সে সময় এই দেশের নারীরা শুধু যে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন, সাহায্য-সহায়তা করেছেন তা নয়, অস্ত্র হাতে পুরুষদের পাশাপাশি তারা যুদ্ধও করেছেন। কাদা-জলে আর খোলা আকাশের তলে আত্মপ্রত্যয়ী দামাল মেয়েরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন; সাহসের সঙ্গে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে নারী সমাজের ভূমিকা ছিল বহুমাত্রিক। নারী সমরে ছিল, ছিল নেপথ্যের শক্তি-সাহসে। এক কথায় মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা ঈর্ষণীয়, যা ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধজয়ের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল হয়ে আছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নারীরা নানা কৌশলে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। জানা যায়, বন্দুক চালানো, গ্রেনেড নিক্ষেপ, ব্যারিকেড তৈরি, আত্মরক্ষার্থে মরিচের গুঁড়া শত্রুর গায়ে নিক্ষেপ ইত্যাদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো নারীদের। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাহাড়ঘেরা নির্জন জায়গায় এবং কোনো কোনো বাড়িতে এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ নারীরা এসব প্রশিক্ষণ দিতেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে যে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, তাতে ছেলেদের পাশাপাশি তরুণী, সচেতন ছাত্রীদের অংশগ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতো। ঢাকার কলাবাগান, রাজারবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বিভিন্ন স্থানে নারী ব্রিগেড তৈরি ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কাঠের বন্দুক হাতে নিয়ে বহু ছাত্রী অস্ত্র প্রশিক্ষণে অংশ নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নিয়ে প্রথম সশস্ত্র ব্রিগেড তৈরি করেন একজন নারী কমান্ডার। সেখানে ছাত্রীদের রাইফেল চালানো, শরীরচর্চা, ব্যারিকেড তৈরি ও প্রাথমিক চিকিত্সা শিক্ষা দেওয়া হতো।
মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের ভূমিকাও ছিল ঐতিহাসিক। তারা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে অদম্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। শহিদ রুমীর মা জাহানারা ইমাম বা শহিদ আজাদের মা সাফিয়া বেগমের মতো অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। নারীরা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন যারা, তারাই আবার অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবে কাজ করেছেন। শত্রুদের বিষয়ে, খানসেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবরও পৌঁছে দিয়েছেন সময়ের প্রয়োজনে। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিত্সা করা, তাদের জন্য ওষুধ, খাবার ও কাপড় সংগ্রহ করা, রক্ত ঝরা একাত্তরে নারীদের এ ধরনের নানা সক্রিয় কর্মকাণ্ডই ছিল ‘তাদের মুক্তিযুদ্ধ’।
বেগম সুফিয়া কামাল পাকিস্তানি বাহিনীর নজরদারিতে যুদ্ধের ৯ মাস ঢাকায় নিজ বাড়িতে বসেই নানা কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন, যা তিনি সে সময় দিনলিপিতে লিখেছেন—তা বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস নারীরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সেসব নারীর এই গৌরবগাথা অনেক ক্ষেত্রে অদৃশ্য হয়ে গেছে! যে নারীদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো, আমরা মুক্তির স্বাদ পেলাম, তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করা আমরা নৈতিক দায়িত্ব বটে। তারা আমাদের ‘বীরাঙ্গনা’।
মনে রাখতে হবে, আমাদের প্রিয় লাল-সবুজ পতাকায় পুরুষের রক্তের পাশাপাশি মিশে আছে নারীর রক্ত, নারীর আত্মত্যাগ। সুতরাং সেই সসব নারীর মহান আত্মত্যাগের প্রতি যথাযথ সম্মান জানানোই হোক আমাদের প্রত্যয়।
লেখক : নাট্যকার, গবেষক ও কলাম লেখক