এই ভূখণ্ডের জনগণ উত্সবে জেগে থাকে। স্থির থাকলে ঘেমে যায়। সংসদ কার্যকর থাক কিংবা না থাক, চায়ের স্টলে ঝড় থাকবেই। আপামর জনতা নির্বাচনকে উত্সব হিসেবেই উদ্যাপন করে। সেটা স্থানীয় সরকার বা জাতীয় সরকার নির্বাচন যা-ই হোক না কেন! এমনকি পেশাদার/ব্যবসায়ী/সংস্থা যে পর্যায়ের নির্বাচনই হোক। তবে জাতীয় নির্বাচন যে রঙের হয়, অন্য নির্বাচনগুলো (ইলেকশন/সিলেকশন/দুর্বৃত্তায়ন) সাধারণত সে রঙেই রাঙা থাকে। এই উত্সবপাগল জনতার দুর্ভাগ্য, দীর্ঘদিন তারা নির্বাচনি উত্সবের স্বাদবঞ্চিত।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পায়। জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র ব্যতীত দলগুলো প্রার্থী দিয়ে থাকে। এখন দলের ভেতর যদি অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র না থাকে, আর নমিনেশন বাণিজ্যে প্রার্থী কেনাবেচা হয়, তাহলে সাধারণ জনগণের ভাগ্য থেকে গণতন্ত্রের মায়াবী ছলনার কালো আয়না কিছুতেই দূর হবে না। একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রথম শর্ত। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি।
নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এখানে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি হলে নির্বাচনি সংকট অবশ্যম্ভাবী। নির্বাচন পরিচালনা সংশ্লিষ্টদের জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে একটি প্রবণতা দেখা যায়, ক্ষমতা পেলে অনেকেই স্বেচ্ছাচার হয়ে যায়। নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিও ভুলে যায়। ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদি করার আত্মঘাতী বন্দোবস্তে লিপ্ত হয়। আবার ক্ষমতার বাইরে থাকলে ক্ষমতার জন্য উন্মাদ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে কার্যকর সংস্কার অত্যাবশ্যক। রাষ্ট্রপতি- সংসদ ও স্থানীয় সরকার সব পর্যায়ের মেয়াদ চার বছর করা হলে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার পথ সংকুচিত হবে। সরকারের মেয়াদ চার বছর করা হলে সাংবিধানিক প্রতিটি পদের মেয়াদ অবধারিতভাবেই চার বছর করতে হবে। সেই সঙ্গে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক পদে দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ বয়স ৬৫ বছর ও সংসদ সদস্য পদে ৭০ বছর নির্ধারণ করা যেতে পারে। শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে তা ৭৫ বছর নির্ধারণ হতে পারে। দুই মেয়াদের বেশি একই পদে স্থানীয় সরকারের কোনো পদ এবং মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার বিধান করা হলে স্বেচ্ছাচার হওয়ার পথ অনেকাংশেই রুদ্ধ হবে।
সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে শর্ত টানা দুই বার নির্ধারিত করে মধ্যে এক মেয়াদ বিরতি নেওয়ার বিধান রাখা যেতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার পাশাপাশি উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করতে হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সরাসরি ভোটেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও করা যেতে পারে। প্রত্যক নির্বাচনে না ভোটের বিধান রাখা প্রয়োজন। বরং না ভোটের বিধান না থাকটা অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত।
স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরকে শক্তিশালী করা প্রশ্নাতীত জরুরি হয়ে আছে। স্থানীয় সরকারে প্রতিনিধিদের বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুবিধা বৃদ্ধি করাও আশু প্রয়োজন। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের। উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের ক্ষমতা ও কার্যপরিধি বিস্তৃত করার পাশাপাশি জবাবদিহিও বৃদ্ধি করা আবশ্যক। সেই সঙ্গে জেলা পরিষদকে আরো গণমুখী করতে হবে। জেলা পরিষদের ভোটারের সংখ্যা ও আওতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সংসদ সদস্যদের প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সব পর্যায়ে নির্বাচনে শৃঙ্খলা আনয়নে একটি সমন্বিত স্থায়ী নির্বাচনি ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করতে পারলে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট বহু প্রশ্নের উত্তর ও সমাধান হয়ে যাবে। জনগণ স্থায়ীভাবে জানবে সব নির্বাচনের তারিখ। তখন নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আসবে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এক্ষেত্রে প্রথমেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়ে নির্বাচনি যাত্রা শুরু হতে পারে।
ছাত্র সংসদের মেয়াদ দুই বছর করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলগুলো রাজনীতিমুক্ত রাখার উপায় খুঁজতে হবে। যদিও ছাত্র সংসদ নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে ইউনিয়ন পরিষদ-উপজেলা পরিষদ-জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যায়ক্রমে আয়োজন করা যেতে পারে। সবশেষে জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একই সঙ্গে করা যেতে পারে। প্রত্যেকটি নির্বাচনের একটি চিরস্থায়ী ও সুনির্দিষ্ট তারিখ ক্যলেন্ডার আকারে নির্ধারিত থাকলে জনগণ আগে থেকেই নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কে অবগত থাকবে। বিশেষ কোনো কারণে কোনো পর্যায়ের মেয়াদ পূর্ণ না হলে অন্তর্বর্তী নির্বাচন হবে।
প্রতিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। প্রয়োজন নির্বাচনি বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ। যেখানে প্রতিশ্রুতিশীল দেশপ্রেমিক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে। নির্বাচনে কালো টাকা- অতিরিক্ত টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার কঠোর হস্তে বন্ধ করতে হবে। মোটর ও অন্য গাড়িবহর ব্যবহার করে প্রার্থীর প্রচারণা বন্ধ রাখতে হবে। অতীব প্রয়োজনে গাড়ির সংখ্যা সীমিত ও সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়। প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয় নির্বাচন কমিশন বহনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে জামানত সমান্তরাল করা এবং নির্দিষ্টসংখ্যক ভোট না পেলে জামানত বাজেয়াপ্ত করার বিধান প্রয়োগ করতে হবে।
শহিদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে কল্যাণকর ও জনগণের রাষ্ট্র করতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। যেখানে ডিম আগে না মুরগি আগের মতো সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে বিতর্ক আনা দুঃখজনক। গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার শেষে সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারলে সেটা হবে অনন্য অর্জন। সময়ের বিবর্তনে বাস্তবতার নিরিখে নির্বাচনি সরকারকেও গণমুখী কল্যাণকর সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে। রক্তে লেখা বাংলাদেশে প্রতিটি শহিদের আত্মত্যাগ সার্থক হোক!
লেখক : নিবন্ধকার