নৈতিক নীতির ব্যবস্থা এবং নৈতিকতা সর্বদা মানুষের আচরণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। প্রাচ্যের প্রবীণ প্রশাসনিক চিন্তাবিদ রমেশ কুমার অরোরা জনপ্রশাসনের প্রেক্ষাপটে নৈতিকতার বারোটি সর্বোচ্চ সারকথা তুলে ধরেছেন, যা সামগ্রিক শাসনের প্রেক্ষাপটেও মনোযোগ ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে এই সর্বজনীন নীতিগুলো এখন বাংলাদেশের দৃশ্যপটের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হবে, কেননা জনপ্রত্যাশা পূরণে এসব নীতির অনুশীলন ও প্রতিপালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা এবং যৌক্তিকতার জন্য গভীর মনোযোগ আধুনিক সংগঠনের মূল ভিত্তি। বৈধতা ও যৌক্তিকতা উভয়েরই রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিটি জাতীয় পরিবেশে সর্বোচ্চ মনোযোগের দাবি রাখে, তা উন্নত বা উন্নয়নশীল যে সমাজই হোক না কেন। প্রকৃতপক্ষে, বৈধতা এবং যৌক্তিকতা সঠিক এবং কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আইনপ্রণেতা এবং নির্বাহকদের রোল মডেল হওয়া উচিত। তবে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সমাজে প্রভাবশালীদের দ্বারা নিয়মকানুন লঙ্ঘন ও যুক্তিহীনতার অনেক নজির রয়েছে।
যদিও জবাবদিহিতা একটি আইনি ব্যাপার, দায়িত্ব একটি ব্যক্তিগত এবং সেই সঙ্গে একটি নৈতিক ব্যাপার। যদি কেউ তার দায়িত্বের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে, যেমন সে তার পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধ, তবে দায়বদ্ধতার বিষয়টি একটি স্বয়ংক্রিয় গতি পায়। আমরা সব সময় আমাদের পরিবারের জন্য সর্বোত্তম করার চেষ্টা করি। তবে যখন আমাদের সংগঠন ও জাতির বিষয়টি সামনে আসে, তখন কি আমরা সব সময় একই ধারায় চিন্তা করি? প্রকৃতপক্ষে, আমরা যদি আমাদের কর্তব্যের প্রতি সত্যিই দায়বদ্ধ হই, তবে জবাবদিহির বিষয়টি কম প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
যে কোনো কাজে সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালানোর জন্য অঙ্গীকার অপরিহার্য। কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং অর্পিত দায়িত্ব ছাড়া কোনো কাজই পরিপূর্ণতা নিয়ে করা যায় না। উচ্চস্তরের প্রতিশ্রুতি এমনকি মাঝারি ধরনের পারফরম্যান্সকেও মহীয়ান করতে পারে। উচ্চ প্রতিশ্রুতির কারণে একজন সাধারণ কর্মচারীও অনেক উন্নতি করতে পারে এবং একটি প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধি এবং সাফল্যে আরো অবদান রাখতে পারে। একইভাবে, প্রতিশ্রুতির অভাব এমনকি একজন উচ্চ যোগ্য এবং উচ্চ কর্মক্ষমতাসম্পন্ন কর্মচারীর জন্যও ব্যর্থতার কারণ হতে পারে।
কেউ কি মধ্যপন্থা নিয়ে খুশি থাকবেন বা নাকি শ্রেষ্ঠত্বের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত? অনেকে দ্বিতীয় বিকল্পের পক্ষে এবং খুব সঠিকভাবে তাই। একজন ব্যক্তি বা কর্মচারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের তাগিদ এমনভাবে গ্রথিত হওয়া উচিত, যাতে তিনি কেবল সুবিধার জন্য না যান এবং গুণগত কার্যকলাপ ও সিদ্ধান্তের জায়গায় কেবল আত্মতুষ্টির সন্ধান না করেন। এই ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক অঙ্গনে এটি আরো প্রাসঙ্গিক, যেখানে সামগ্রিক পরিবেশে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য প্রত্যাশা একটি বাজওয়ার্ড হয়ে উঠেছে।
ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক এবং সামাজিক লক্ষ্যগুলির সংমিশ্রণ একজন কর্মচারীর প্রাথমিক এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত, যাতে ত্রিমুখী পুরস্কার ব্যবস্থা (ট্রিপল রিওয়ার্ড সিস্টেম) বাস্তবায়িত হতে পারে। ত্রিমুখী পুরস্কার ব্যবস্থা বলতে একজন কর্মচারীর পক্ষ থেকে সর্বোত্তম কর্মক্ষমতা বোঝায়, যা কর্মচারী বা ব্যবস্থাপক দ্বারা উন্নত ও অনুপ্রাণিত হয়। সংস্থার লক্ষ্যগুলো অর্জন করে কর্মচারী তার প্রতিশ্রুতিতে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করেন। ফলস্বরূপ, কর্মচারীর পরিবার একটি ভালো পরিবার প্রধান দ্বারা উপকৃত হয়। একজন মানুষ তার পরিবারে সুখী থাকলে তার সুখ সমাজেও ছড়িয়ে পড়ে।
নাগরিকদের দাবি ও সাংগঠনিক চাহিদার প্রতি সাড়াপ্রবণতা আধুনিক জনপ্রশাসনের ভিত্তি। সব সমসাময়িক প্রশাসনিক সংস্কার কর্মসূচি এভাবে প্রশাসনকে আরো বেশি নাগরিকবান্ধব করার জন্য নাগরিকদের প্রতি সরকারি কর্মচারীদের সাড়াপ্রবণতা ওপর সর্বাধিক জোর দেয়। একই সময়ে, একজন সরকারি কর্মচারী বা একজন কর্মচারী সাংগঠনিক পরিবর্তন এবং রূপান্তরের জন্য সমানভাবে সাড়াপ্রবণ হবে বলে আশা করা হয়। তবে, প্রক্রিয়া চলাকালীন বিচ্যুতি ঘটলে কর্মীদের স্থিতিস্থাপকতা দেখানোর এবং প্রত্যাশিত অবস্থানে ফিরে আসার ক্ষমতা থাকতে হবে।
কর্মচারীরা বিশেষত্বের পরিবর্তে সর্বজনীনতাকে অগ্রাধিকার দেবেন। নীতি প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত কার্যকর করার সময় সর্বাধিকসংখ্যক মানুষের জন্য প্রধান আগ্রহ ও উদ্বেগ থাকবে। এমন নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যা শুধু সুবিধাভোগী অংশের জন্য নয় বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জন্য উপকার বয়ে আনবে। একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পরিবর্তে সর্বাধিকসংখ্যক লোকের জন্য আগ্রহ ও উদ্বেগ নীতি নির্ধারক এবং নির্বাহকদের বেশির ভাগ সময় সঠিক নীতি গ্রহণ করতে সহায়তা করবে।
সরকারি কর্মচারীরা অবশ্যই নিয়ম মেনে চলবেন। তবে, তাদের দায়িত্ব পালন করার সময় সরকারি কর্মচারী বা কর্মচারীরা সমাজের অভাবী এবং কম সুবিধাপ্রাপ্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন। প্রকৃতপক্ষে, সরকারি কর্মচারী বা কর্মচারীরা যদি নিজেকে অন্যের অবস্থানে চিন্তা করতে পারে, তবেই উত্তম। নিজেকে অন্যের অবস্থানে চিন্তা করতে পারা কর্মচারী এবং কর্মচারীদের অভাবী মানুষের বেদনা ও যন্ত্রণা বোঝতে সাহায্য করে। সরকারি কর্মচারীরা শক্তিশালীদের প্রতি আলাদা অনুগ্রহ দেখাবেন না বলেই আশা করা হয়।
কর্মচারীরা অবশ্যই অভিযোজনে সর্বজনীন এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে উদার হবেন। তবে তারা অন্যান্য স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেন। তারা বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণে চিন্তা করবেন এবং স্থানীয়ভাবে কাজ করবেন, অর্থাত্ তারা তাদের মাতৃভূমির উন্নতির জন্য জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা ব্যবহার করবেন। যদি তারা তা করতে পারেন, তাহলে তারা বিশ্বের পাশাপাশি ভালো চিন্তা করার অবস্থানে থাকবেন। কর্মচারীরা যদি জাতীয় স্বার্থ এবং মর্যাদাকে অন্যান্য স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখেন, তবে তাদের পরিষেবাগুলো অবশ্যই উন্নত হবে।
আইনের শাসনের চেয়ে ন্যায়বিচার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আইনের শাসনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সময় দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এবং সরকারি কর্মচারীরা সাম্য, ন্যায়, নিরপেক্ষতা এবং বস্তুনিষ্ঠতার নীতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন এবং পদমর্যাদা, অবস্থান, ক্ষমতা, শ্রেণি, বর্ণের মাপকাঠিতে কোনো বিশেষ অনুগ্রহ করা উচিত নয়। সব স্তরে ন্যায়বিচারের ব্যবস্থাও একটি ন্যায়সংগত সমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রাখতে পারে।
জবাবদিহি সুশাসনের মূল ভিত্তি এবং স্বচ্ছতা হলো সুশাসনের দর্পণ, যার দ্বারা একটি সরকারের বাস্তব কর্মক্ষমতা এবং উদ্দেশ্যকে পরখ করা যায়। সরকারি কর্মচারী বা কর্মচারীরা এভাবে তাদের রুটিন কাজের পাশাপাশি নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন বলে আশা করা হয়। সরকারি কর্মচারীরা যদি প্রকৃত অর্থে স্বচ্ছ থাকতে পারেন, তাহলে নাগরিকদের মনের সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে এবং তাদের ওপর নির্ভরতা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।
সততাকে এমন একটি প্রত্যয় বলা যেতে পারে, যা ক্ষমতা, ধারাবাহিকতা এবং প্রতিশ্রুতিকে অন্তর্ভুক্ত করে। সক্ষম এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যক্তিরা তাদের কথা এবং কাজে সততা প্রদর্শন করেন। সরকারি কর্মচারীরা নীতি বাস্তবায়ন এবং সম্পদ বণ্টনের সময় সততা অনুশীলন করবেন বলেই আশা করা হয়। তারা নিশ্চিতভাবে ক্ষমতাকে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণের জন্য এবং অন্য অবৈধ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহার করবেন না। প্রতিটি কাজে সততার অনুশীলন সরকারি কর্মচারীদের পরিশীলিত কর্মী এবং পরিপূর্ণতাবাদীতে পরিণত করবে।
নীতিনির্ধারক, প্রশাসক ও সরকারি খাতের কর্মচারীদের জন্য পূর্ববর্তী নীতিগুলো প্রযোজ্য এবং সর্বাধিক গুরুত্ব বহন করে। বস্তুতপক্ষে উল্লিখিত নীতিগুলো প্রত্যেক যুক্তিবাদী মানুষের জন্যও প্রযোজ্য। তালিকায় আরো নীতি যোগ করা যেতে পারে। তবে শুধু তালিকায় যোগ করা বা বিস্তৃত করা কোনো অর্থপূর্ণ ফলাফল বয়ে আনবে না। আমাদের দৈনন্দিন এবং পেশাগত জীবনে উল্লিখিত নীতিসমূহের অনুশীলন আমাদের নিজেদের পরিবার ও সরকারের জন্য অবশ্যই ভালো ফল বয়ে আনবে এবং এ প্রক্রিয়ায় সমগ্র সমাজ এবং দেশ সবক্ষেত্রে আরো ভালো অবস্থানে থাকবে। নতুন বাংলাদেশে আমরা এমন গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করতেই পারি।
লেখক : প্রফেসর, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়