স্বদেশপ্রেম হলো মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ এবং আত্মত্যাগের মনোভাব। এটি একজন ব্যক্তির অন্তরের অনুভূতি, যা তাকে তার দেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং দায়িত্বশীল করে তোলে। স্বদেশপ্রেম শুধু আবেগ নয়; এটি একটি নৈতিক দায়িত্ব, যা সমাজ ও দেশের উন্নয়নে প্রভাব ফেলে।
স্বদেশপ্রেম মানুষকে একত্রিত করে এবং জাতীয় ঐক্যের ভিত মজবুত করে। এটি জাতিকে বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে একত্রে কাজ করতে প্রেরণা জোগায়। মানুষকে দেশের কল্যাণে কাজ করতে উত্সাহিত করে। নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্বশীলতার বোধ জাগিয়ে তোলে, যা আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। স্বদেশপ্রেম মানুষকে তার সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে দেশের গৌরবময় অধ্যায় তুলে ধরা হয়। স্বদেশপ্রেম মানুষের হূদয়ে লালিত হয়। তা প্রকাশ পায় জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে দেশের মানুষের কর্মের মাধ্যমে। দেশপ্রেমীর নিজ দেশের প্রতি রয়েছে সীমাহীন ভালোবাসা ও আনুগত্য।
বিশ্বের উন্নত জাতিগুলোর সবই স্বদেশের জন্য আত্মত্যাগের মাধ্যমেই উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছে। স্বদেশপ্রেম না থাকলে দেশ ও জাতির উন্নতি আশা করা যায় না। মানুষ সমগ্র বিশ্বের বাসিন্দা হলেও একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সে বেড়ে ওঠে। একটি বিশেষ দেশের অধিবাসী হিসেবে সে নিজেকে পরিচিত করে, পরিচিতি লাভ করে। এই পরিচিতি দানকারী দেশ-ই তার স্বদেশ বা মাতৃভূমি।
মানুষ স্বদেশে জন্মগ্রহণ করে ও স্বদেশের ভালোবাসায় লালিত-পালিত হয়। নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সব উপাদান সে স্বদেশ থেকে পায় বা অর্জন করে। ফলে স্বদেশের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়। এজন্য স্বদেশের গৌরবে গৌরবান্বিত হয় এবং স্বদেশের আপমানে অপমানিত হয়। স্বদেশের মান-মর্যাদা রক্ষায় নিজের জানপ্রাণ উত্সর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকে। স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষায়, স্বদেশের মানুষের কল্যাণ সাধনে মানুষের মনে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হয়। সংগ্রাম করে জীবন বাজি রেখে স্মরণীয় হয়ে ওঠে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানে পরিণত হয়। তাদের আত্মত্যাগের কীর্তি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে চিরকাল।
কেবল দেশকে ভালোবাসার মধ্যে দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ নয়। স্বদেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। স্বদেশপ্রেম কখনো বিশ্বপ্রেমের বাধা হয় না। দেশপ্রেম যদি বিশ্ববন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয়, তাহলে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না। জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবাই দেশপ্রেমের চেতনায় উত্সাহিত হওয়া/ থাকা উচিত। যে নিজের দেশকে ভালোবাসে না সে অন্য দেশ, ভাষা, গোষ্ঠী তথা মানুষকে ভালোবাসতে পারবে না। তাই, দেশপ্রেমের মাধ্যমেই বিশ্বপ্রেমের বিকাশ ঘটে।
দেশপ্রেমের মহত্ চেতনায় মানব চরিত্রের সত্ গুণাবলির বিকাশ ঘটে। মানুষের মন থেকে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা দূর হয়। স্বদেশপ্রেম মানুষকে উদার ও মহত্ করে, পরার্থে জীবন উত্সর্গ করতে প্রেরণা দেয়। স্বদেশপ্রেমের কারণেই মানুষ আত্মত্যাগ করে, দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করে, দেশবাসীকে ভালোবাসে। বৈষম্য ও অসামঞ্জস্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের মর্জাদা বৃদ্ধিতে কাজ করে।
জন্মভূমি সবারই প্রিয়, তা রক্ষার দায়িত্ব সবার। তবে মনে রাখতে হবে নিজের দেশকে রক্ষার নামে অন্যকে আক্রমণ করা মানবতাবিরোধী। অন্য দেশের নাগরিককে হেয় করা, অযথা অন্য দেশের বিরুদ্ধাচারণ করা দেশপ্রেম নয়, বরং গর্হিত কাজ। স্বদেশপ্রেমের মতো মহত্ গুণ আর নেই। এটি অনেক পূণ্যের কাজ। মহানবি (সা.) বলেছেন, স্বদেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। রাসুল (সা.) নিজ মাতৃভূমিকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। মদিনায় হিজরতের পর তিনি মক্কার (স্বদেশ) কথা মনে হলেই ব্যতীত হয়ে উঠতেন, কান্নায় ভেঙে পড়তেন। তাই, জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবার উচিত স্বদেশকে ভালোবাসা।
স্বদেশপ্রেম জাতি গঠনের ভিত্তি। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শুধু ভালোবাসা নয়, প্রত্যেক নাগরিকের উচিত নিজের দেশের প্রতি আন্তরিক দায়িত্ব পালন করা এবং নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বদেশপ্রেমকে ধারণ করা। এর মাধ্যমেই একটি জাতি সমৃদ্ধ, শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
লেখক : পোস্টাল অপারেটর, সিলেট বিভাগ