তারাই একটি জাতির উন্নয়নের মূল দিশারি, যারা সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে জাতিকে অন্ধকার হতে আলোকের ঝরনাধারায় আনয়নে সহায়তা করেন। একটি দেশের বুদ্ধিজীবীরা সেই ভূমিকাই পালন করে থাকেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী নিধনকার্য সম্পাদন করেছিল। ১৪ ডিসেম্বর তারা এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন জাতিকে নেতৃত্ব ও জ্ঞানবুদ্ধিতে অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখার মরিয়া চেষ্টা করেছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, একাত্তরে আজকের দিনে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সুগভীর ষড়যন্ত্র। তারা যথার্থই বুঝিয়াছিল— একটি জাতির বুদ্ধিজীবীরা তাদের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রকৌশল, সাহিত্য, সংস্কৃতি— প্রতিটি ক্ষেত্রেই বুদ্ধিজীবীরা জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। তারা জাতির অগ্রগতির ট্রেনকে লাইনচ্যুত হতে দেন না। তাই, তাদের নির্মূল করে একটি জাতির নিউক্লিয়াসে বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।
দৃশ্যত, স্বাধীনতার পর অর্ধশতাব্দী অতিবাহিত হলেও আমরা এখনো সেই শূন্যতা পূরণ করতে সক্ষম হইনি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৯৭১ সালে ছিল আনুমানিক সাড়ে ৭ কোটি। আজ তা বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ কোটির বেশি হয়েছে। কিন্তু এই বর্ধিত জনসংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন খাতে বিশেষজ্ঞ তথা বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি। উলটো, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের দক্ষতার অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ডাক্তার ও গবেষকের অভাব, শিক্ষাক্ষেত্রে গুণমানের শিক্ষকসংকট, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের ঘাটতি— এই সবই আমাদের উন্নয়নযাত্রাকে মন্থর করেছে। আমাদের উন্নয়নযাত্রার যেই ট্রেন, তার ইঞ্জিন সময়োপযোগী উন্নত নয়, এই ট্রেন চলার জন্য যেই রেললাইন রয়েছে, তা নড়বড়ে। ফলে আমরা যতখানি এগুতে পারতাম, ততখানি পারছি না।
আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, বুদ্ধিজীবীরা একটি জাতির মস্তিষ্ক, আর এই মস্তিষ্ক ব্যতীত কোনো জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। তাই, জাতিকে অন্ধকার হতে আলোর পথে আনতে বুদ্ধিজীবী তৈরির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করাটাই আমাদের অন্যতম মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের উন্নতির মূলে বুদ্ধিজীবীদের অবদান অপরিসীম। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশ তাদের প্রযুক্তি ও গবেষণায় যেই বিপ্লব ঘটিয়েছে, তার পেছনে ছিল অগণিত মেধাবী ব্যক্তির নিরলস প্রচেষ্টা।
দার্শনিক সক্রেটিস বলিয়াছিলেন, ‘একটি জ্ঞাননির্ভর সমাজই উন্নত সমাজ’। এই উক্তি বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলো সর্বদা গুরুত্ব প্রদান করেছে। অথচ, বাংলাদেশে আমরা এই বিষয়ে এখনো যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারিনি। বুদ্ধিজীবী নিধনের কারণে আমরা যেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি, তা কেবল অতীতের শূন্যতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং এই ঘাটতি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যেক ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে মানহীন শিক্ষা ও গবেষণার অভাব, স্বাস্থ্যসেবায় মানসম্মত সেবার সংকট, শিল্প ও বাণিজ্যে উদ্ভাবনের অভাব— এসবই প্রমাণ করে যে, আমরা এখনো বুদ্ধিজীবী সৃষ্টির ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি।
এই ঘাটতি পূরণ করার জন্য জাতিকে সর্বাগ্রে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষা ও গবেষণার ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করে নতুন প্রজন্মকে জ্ঞানবিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে হবে। বুদ্ধিজীবী সৃষ্টির জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল সংস্কার এনে গুণমান বৃদ্ধি করতে হবে। জাতির প্রত্যেক স্তরে জ্ঞানের চর্চা এবং গবেষণার প্রসার নিশ্চিত করতে হবে। যারা ১৯৭১ সালে আমাদের মেধা নিধন করেছিল, তাদের উদ্দেশ্য ছিল জাতির উন্নয়নকে থামিয়ে দেওয়া। কিন্তু আমাদের এখন প্রয়োজন সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে মেধার বিস্তার ঘটানো। তার মাধ্যমেই আমরা ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বরের শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে পারব।