বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের মাত্র ১২ দিনের বজ্র-আন্দোলনের মুখে গত রোববার (৮ ডিসেম্বর) ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। রোববার রাতেই সিরিয়া থেকে পালিয়ে মিত্র দেশ রাশিয়াতে আশ্রয় নেন তিনি। কেন এমন পতন হলো আসাদের, সে ও তার পরিবার এবং এমনকি সিরিয়ার ভবিষ্যতই-বা কোন পথে— এসব প্রশ্নে নানা মত দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। তাদের বক্তব্য, পরিসমাপ্তি ঘটেছে আসাদ যুগের।
নিজের নিরাপত্তার জন্য আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে গেছেন। রেখে গেছেন ‘এক বিধ্বস্ত দামেস্ক’। আসাদ প্রশাসনের অধীনে সিরিয়ার অবস্থা সত্যিই সঙ্গীন হয়ে উঠতে দেখেছে বিশ্ববাসী। দেশটিতে এখন বিরোধী দলগুলো রাজনীতি করার সুযোগ পাচ্ছে। তারাই এখন ক্ষমতার মসনদে। অথচ একসময় আসাদ বাহিনীর নিপীড়নের জাতাকলে পীষ্ট ছিল দেশের বিভিন্ন উপজাতি, জাতি ও ধর্মের প্রতিনিধিত্বারী এসব বিরোধী দল।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিরোধী দলমতের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের স্টিম রোলার চালিয়েছিল আসাদ প্রশাসন। কারাগারে নেওয়া হয়েছিল বহুজনকে। আসাদের পতনের পর মেজ্জে ও সেদনায়া নামক এরকম দুইটি কুখ্যাত কারাগার থেকে মুক্ত হন কয়েদিরা। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য! আসাদের অনুগতরা তাড়াহুড়ো করে বিভিন্ন প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা চালিয়েছে বটে, কিন্তু কারাগারের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পরিত্যক্ত আর্কাইভগুলো থেকে ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গণহত্যা’ চালানোর প্রমাণগুলো স্পষ্টভাবে মুছতে পারেনি।
যাহোক, সিরিয়ায় আসাদ জামানার দীর্ঘ ছায়া এবং মর্মান্তিক সব বিদ্রোহ-যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও দেশটির রাজনীতির ভূত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা থেমে নেই। অনেকে এরই মধ্যে বলেছেন, এই মুহূর্তটি এক দশক আগেও আসতে পারত। ২০১৩ সালেই সিরিয়ার ভাগ্য লেখা হয়ে যেতে পারত নতুন করে। আর তাতে করে পরবর্তী সময়গুলোতে সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলার রাশ টানা যেত। বিশেষত, ২০১৩ সালের পর বিভিন্ন সংঘাতে যেসব হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা আটকানো যেত। ফলে সিরিয়ায় সৃষ্ট ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেত সিরিয়ানরা।
আসাদ সরকারের বিদায়ের পর সিরিয়া-সংকটের বর্বরতার নানা প্রমাণ সামনে আসছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যায়, বিগত বছরগুলোতে সিরিয়ার হানাহানিতে ছয় লাখের বেশি প্রাণ ঝরেছে। যদিও দাবি করা হয়, প্রকৃত সংখ্যা দশ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তাছাড়া এই সংকটের মুখে সিরিয়া থেকে লাখ লাখ বাসিন্দা বাস্তুচ্যুতের শিকার হয়েছে।
ঠিক এমন একটি ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেই সিরিয়ার মাটিতে আবির্ভাব ঘটে দায়েশের। অভিযোগ আছে, দায়েশ তার ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ বিস্তার করেছিল সিরিয়ার রাক্কা থেকে ইরাক পর্যন্ত। এমনকি দেশ দুইটির বাইরেও দায়েশ সন্ত্রাসের জাল বিছিয়েছিল। এর ফলে বিশ্বজুড়ে চরমপন্থার কালো ছায়া নেমে আসে বলে অভিযোগ করা হয়। ইতিহাসের এমন একটি অধ্যায়ে কী পরিমাণ রক্তপাত ঘটেছে, কী ধরনের বর্বরতা চলেছে, তা না বললেও আন্দাজ করে নেওয়া যায়। বিশ্লেষকরা বলেন, সিরিয়া বা ইরাকে যে ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে, তা রাশিয়ার ইউক্রেনের আক্রমণের ভয়াবহতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এর জন্য অবশ্যই আসাদ সরকার দায়ী। তবে অন্যরাও এর দায় এড়াতে পারেনা। সর্বোপরি, নির্দোষ বলা যায় না বিশ্বসম্প্রদায়কেও।
বিদেশী বা ভাড়াটে যোদ্ধা, রুশ বিমানবাহিনী এবং হিজবুল্লাহ জঙ্গিদের ব্যবহার করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে বসেছিলেন প্রেসিডেন্ট আসাদ। নিজের জনগণের ওপর অবরোধ, অনাহার ও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ফলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আসাদ বাহিনীর মুখোমুখী লড়াই অনেকটা অবধারিত হয়ে পড়ে। আর সেই লড়াইয়ে দেশটির বাজারঘাট, হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে শুরু করে বিশেষ করে বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়, সিরিয়ার কপালে লেপ্টে যায় ‘একটি মাদক-রাষ্ট্র’ তকমা। আসাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের অভিযোগ হলো, তার সরকার মাদক ব্যবসায়ীদের বিশেষ সুবিধা করে দিয়েছিল। এতে করে অভিজাতরা ফুলেফেঁপে ওঠে।
অন্যদিকে, সাধারণ সিরিয়রা উপনীত হয় কঠিন দারিদে্র্যর মধ্যে। বিদ্যুতের জোগান কমে যেতে থাকে। সব মিলিয়ে অর্থনীতি হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সিরিয়ার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ায় রাশিয়া ও ইরান। দেশ দুইটি আসাদকে সমর্থন দিতে থাকে। এতে করে সিরিয়া নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর পরিকল্পনা একের পর এক ব্যর্থ হতে থাকে। পশ্চিমারা আসাদকে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা ভেঙে পড়ে একটা সময়ে এসে। এক্ষেত্রে পশ্চিমাদের কিছু ক্ষেত্রে ভুলও ছিল! তারা সিরিয়া, তথা আসাদের শত্রুদের ওপর বেশি বেশি নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকে এবং দামেস্কের ওপর থেকে শিথিল করা হয় বিভিন্ন বিধিনিষেধ। পশ্চিমাদের এ ধরনের প্রচেষ্টার সুযোগ নিয়ে আসাদ সরকার নৃশংস কৌশলগুলো আরও বাড়িয়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছিল।
মূলত ২০১৩ সালেই সুযোগ এসেছিল আসাদ সরকারের লাগাম টেনে ধরার। সে বছর সিরিয়ার ভাগ্য সত্যিই বদলে যেতে পারত। ঘটনার সূত্রপাত ২০১৩ সালের আগস্টে। এ মাসে দেশটির পূর্ব ঘৌতা নামক এলাকায় সারিন গ্যাস নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে, যার মধ্য দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর হতাশা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐ ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারকে ‘রেড লাইন বা লাল রেখা’ অতিক্রম করার সামিল হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। নিষিদ্ধঘোষিত এই অস্ত্র ব্যবহারের ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিতও দিয়েছিল ওবামা প্রশাসন। তবে যখন আসাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সেই চূড়ান্ত মুহূর্তটি এসেছিল, তখন কোনো এক অদৃশ্য কারণে ওবামা প্রশাসনের হাত থেকে রেহায় পেয়ে যান আসাদ। বরং পদক্ষেপ নেওয়া দূরে থাক, রাশিয়ার মধ্যস্থতায় জবাবদিহিতা এড়াতে সক্ষম হন আসাদ।
ঐ ঘটনার পর সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রাগার ধ্বংস করার দাবি উঠেছিল। তেমনটা ঘটলে আসাদ সরকারের প্রাণঘাতী অস্ত্র উৎপাদনব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে যেতে পারত। তবে দিনশেষে তেমনটা ঘটেনি। বরং ‘আসাদকে বিদায় নিতে হবে’— এ ধরনের ফাঁপা বাগাড়ম্বরের ফিসফিসানিতে আসাদ রেজিম পতন এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরপর সিরিয়ার মাটিতে বহু ঘটনা ঘটে গেছে।
শাসকগোষ্ঠী ‘রাসায়নিক যুদ্ধ’ অব্যাহত রেখেছিল। ফলে ঘৌতাসহ দেশটির অনেক অঞ্চল পরিণত হয় কবরস্থানে। জনগণকে অবরোধ এবং রাসায়নিক হামলার কৌশল সিরিয়া সংকটের একটি চিরচেনা বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। আর এ প্রবণতা বিরোধীদের দমনে উৎসাহিত করে তোলে শাসকগোষ্ঠীকে।
২০১৩ সালে আসাদ সরকার বেশ দুর্বল ছিল। অপর পক্ষে সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশনের সমন্বয়ে গঠিত বিরোধী দলটি ছিল গতিশীল। দলত্যাগী এবং নাগরিক সমাজের নেতাদের এই ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী জোটের লক্ষ্য ছিল, সিরিয়ার সর্বস্তরের জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সরকারকে শাসনের কেন্দ্রে নিয়ে আসা। সেসময় আলেপ্পো ও দামেস্কের শহরতলির বিভিন্ন অংশসহ উল্লেখযোগ্য অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণও ছিল বিরোধী দলের হাতে। অর্থাৎ, হালকা একটুখানি ধাক্কাতেই পড়ে যেত আসাদ সরকার।
দায়েশ তখনও আবিভূর্ত হয়নি। এমনকি রাশিয়াও ছিল মাঠের বাইরে। অন্য কোনো পক্ষ থেকেও সামরিক হস্তক্ষেপ ছিল না। এ অবস্থায় সিরিয়ান ন্যাশনাল কোয়ালিশন কোনোভাবে পশ্চিমা সমর্থন পেলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতো অবিশ্বাস্যভাবে। বিমান হামলা বা বলপ্রয়োগের বিশ্বাসযোগ্য হুমকি দিয়েই হয়তো-বা সরকারকে একটা গোণ্ডীর মধ্যে আটকে রাখা যেত অনায়াসে। তবে এমনটা ঘটেনি বরং এর পরিবর্তে আসাদ সরকার নতুন করে সংগঠিত হওয়ার উপলক্ষ পেয়ে যায়। পাশে পায় বন্ধু রাশিয়াকে। এভাবে আসাদ সরকারের হাত ধরে সিরিয়া আস্তে আস্তে নিমজ্জিত হতে থাকে গভীর বিশৃঙ্খলার গহ্বরের মধ্যে।
এই অর্থে বলতে হয়, ২০১৩ সালে নড়বড়ে হয়ে পড়া আসাদ সরকারকে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার অভূতপূর্ব সুযোগ হাতছাড়া করেছিল ওবামা প্রশাসন। অন্তত শেষ দিনগুলোতেও ফাঁপা এই সরকারকে পরাজিত বা আপোষে বাধ্য করা যেত। আর তাতে করে গেল দশকের বিস্ময়কর মানবিক বিপর্যয় এড়ানো যেত। এড়ানো যেত প্রাণহানি, সম্প্রদায় ধ্বংস এবং সর্বোপরি দায়েশের উত্থান।
আজ সিরিয়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে ঝুলছে। অথচ ২০১৩ সালে যদি ‘বৈশ্বিক দ্বিধা’ কাটানো যেত, তাহলে আসাদের বর্বর শাসনব্যবস্থার অধীনে নিষ্পেষিত হতে হতো না সিরিয়াবাসীকে। বারাক ওবামার সেই সিদ্ধান্তহীনতার ক্ষতচিহ্ন থেকে যাবে যুগ যুগ ধরে। অথচ ’১৩ সালে ‘একটিমাত্র সিদ্ধান্ত’ই বদলে দিতে পারত সিরিয়ার গতিমুখ।
লেখক : ওয়াশিংটন ডিসির নিউলাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির স্পেশাল ইনিশিয়েটিভের পরিচালক
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর : সুমৃৎ খান সুজন