জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে সমুন্নত রাখতে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন করেছে। গত ৯ ডিসেম্বর সংগঠনটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে সম্প্রাসারিত করার লক্ষ্যে এবং জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে সমুন্নত রাখতে জাতীয় নাগরিক কমিটি সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এনবিআরের রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত বিভিন্ন ক্ষমতা কমানোর আবেদন জানালেও তা খুব একটা আমলে নেওয়া হয়নি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নকালেও দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এক জোট হয়েই এ দাবি জানিয়েছে। সরকারের ওপর মহলের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকেও এ দাবি জানানো হয়েছে। প্রস্তাবিত অর্থবছরের বাজেটের অর্থবিল বিশ্লেষণ করে বলা যায়, এত কিছুর পরও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য এনবিআরের ক্ষমতা কমানো হলো না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে বাড়ানো হলো।
প্রস্তাবিত অর্থবিলে একজন কমিশনারের সিদ্ধান্ত তার আওতাধীন এলাকায় চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। এতদিন হিসাব জব্দের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হলে কমিশনারকে এনবিআর প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন নিতে হতো। প্রস্তাবিত অর্থবিলের এ ধারা বাজেট চূড়ান্ত ভাবে পাস হলে ১ জুলাই থেকে অতি জরুরি বিষয় ছাড়া সাধারণ আদায়ের ক্ষেত্রে অনুমোদন নেওয়া লাগবে না।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিবিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘এনবিআরের কিছু বিধানের কারণে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হন। এসব বিধান আগামী অর্থবছরে সংশোধন করেই বাস্তবায়নের দাবি জানাই।
হিসাব ও মালামাল জব্দ
বড় অঙ্কের বকেয়া থাকলে সংশ্লিষ্ট কর কার্যালয় থেকে একবার নোটিশ দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর কমিশনার সিদ্ধান্ত নিয়ে করদাতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। স্থানীয় দপ্তর থেকেও মালামাল জব্দ করতে পারবেন। রাজস্ব বকেয়া থাকলে প্রতিষ্ঠানে তালাও দেওয়া যাবে।
ফৌজদারি মামলা
বাজেট প্রস্তাব পেশ করার দিন ৬ জুন থেকে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যমান মানি লন্ডারিং আইনের বাইরেও সর্বশেষ কাস্টমস আইনে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে অর্থ পাচারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান বারবার মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মতো অপরাধ করতে থাকলে তার বিরুদ্ধে এনবিআর প্রয়োজন মনে করলে ফৌজদারি মামলাও করতে পারবে। এতদিন এনবিআর বকেয়া আদায়ে রাজস্ব মামলা করতে পারত।
রিটার্নের স্লিপ ছাড়া সেবা নয়
গত ও চলতি অর্থবছরে রিটার্নের স্লিপ জমা ছাড়া সেবা না দেওয়ার বিধান রাখা হয়। এ বিধানে সাধারণ মানুষ কর পরিশোধে বাধ্য হয়। এ বিধান বাতিলের আবেদন জানালে আমলে নেওয়া হয়নি। বরং প্রস্তাবিত বাজেটে সেবা নেওয়ার আওতা বাড়ানো হয়েছে। ১০ লাখ টাকার জমি, ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি বা লিজ বা হস্তান্তর বা বায়নানামা বা আমমোক্তারনামা নিবন্ধনে; ক্রেডিট কার্ডপ্রাপ্তি ও বহালে; মুসলিম বিবাহ-সংশ্লিষ্ট আইনের অধীনে নিকাহ রেজিস্ট্রার, হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইনের অধীনে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধক ও বিশেষ বিবাহ আইনের অধীনে রেজিস্ট্রার হিসেবে সনদপ্রাপ্তি বা নিয়োগ বহাল রাখতে; জেলা সদর বা পৌরসভায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিশু বা পোষ্য ভর্তিতে; ডাকঘরে ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে; ১০ লাখ টাকার বেশি মেয়াদি আমানত খোলা ও বহাল রাখতে; ৫ লাখ এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে মাসে ১৬ হাজার টাকার বেশি অর্থপ্রাপ্তিতে; ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দেশে বসবাসকারী ভোক্তাদের কাছে পণ্য বা সেবা বিক্রয়ে; হোটেল, রিসোর্টে বেড়াতে গেলে, ভবন তৈরির নকশা দাখিলসহ ৪৫টির বেশি সেবা নিতে হলে রিটার্ন দাখিলের স্লিপ জমা দিতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান করদাতার সঙ্গে সমঝোতা বা অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে এসব সেবা নেওয়ার চেষ্টা করলে এনবিআর আপত্তি করে বন্ধ করতে পারবে।
জরিমানার পরিমাণ কয়েকশ গুণ:
কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বকেয়া আদায়ে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও বকেয়া পরিশোধ না করলে সংশ্লিষ্ট তদন্ত (রাজস্ব) কর্মকর্তার সুপারিশে জরিমানার পরিমাণ নির্ধারণ করার সুযোগ আছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের তৈরি সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ‘মিথ্যা তথ্য দিয়ে কম রাজস্ব পরিশোধ করে আমদানি-রপ্তানি করার সময় অনেক ব্যবসায়ী ধরা পড়েন। এনবিআর পাওনা পরিশোধে নির্দেশ দিলেও বেশির ভাগ সময়ে এসব ব্যবসায়ী মামলা করে বাড়তি রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া স্থগিত রাখেন। তাদের পণ্য বছরের পর বছর বন্দরে ফেলে রাখেন। আবার বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়েও অনেক ব্যবসায়ী আমদানি করা পণ্য জাহাজেই তোলেন না। রপ্তানি করা পণ্য জাহাজ থেকে নামিয়ে বন্দরে ফেলে রাখেন। নতুন কাস্টমস আইনে বলা হয়েছে, শুল্কায়নের ১০ দিনের মধ্যে শুল্ক-কর পরিশোধ করে পণ্য বন্দর থেকে খালাস না নিলে ওই আমদানি-রপ্তানিকারককে জরিমানা দিতে হবে। বন্দরে পৌঁছানোর পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্যের ঘোষণা বা বিল অব এন্টি্র জমা দিতে হবে। এ বিধান না মানলে জরিমানা হবে। আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্ক-কর-চার্জ নির্ধারণের পর ১০ দিনের মধ্যে পরিশোধ না করলে শুল্ক-কর পরিশোধের সর্বশেষ তারিখ থেকে খালাসের সময় পর্যন্ত বার্ষিক ১০ শতাংশ হারে সাধারণ সুদ পরিশোধ করতে হবে। এর পরিমাণ বর্তমান আইনে বাড়ানো হয়েছে। পাওনার কয়েক গুণ করা যাবে।
এইচএস কোড-জনিত জটিলতা দূর হয়নি: কোন পণ্য কোন এইচএস কোডের আওতায় তার ব্যাখ্যা নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একমত না হওয়ায় রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়। এ সমস্যা নিরসনে বারবার আবেদন জানালেও তার সমাধান এবারেও করা হয়নি। এখন রজস্ব পূনর্গঠনের ফলে আয় বৃদ্ধি পাবে, সেই সাথে জঠিলতাও কমবে।
লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন।